গরুর চেয়ে গরুর দুধ ভালো, লেখকের চেয়ে তাঁর লেখা। এই আমার চিরকালের ধারণা-অভিজ্ঞতার ধারে পরীক্ষিত।
দুধ শুধু খেতেই ভালো নয়, পুষ্টি-তুষ্টিকরও। যেমন প্রেয় তেমনি শ্রেয়। কিন্তু গোরকে অখাদ্য বলেই ধরা উচিত–যেহেতু তার কাছে ঘেঁষলেই গুতো খেতে হবে। নিদেন পক্ষে শিঙ-নাড়া তো রয়েছেই।
লেখার মত লেখক ততটা উপাদেয় না হতেও পারেন।
লেখকে সান্নিধ্যে গেলে তিনি গুতোবেনই, আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে-যে-লেখক তখন আপনাদের সামনে নেই। সেই মর্মভেদী কাণ্ড গণ্ডার সদৃশ ভক্তের চর্মভেদী না হলেও অপর সকলের পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। যা শত্রু পরে পরের মত কারো হয়ত উপভোগ্য হলেও পর-পরস্বৈপদী কর্ণভেদী কটুকাটব্য অবাধ অসহনীয়।
তারাশঙ্করের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার জীবনে খুব কমই হয়েছে। তিনি থাকতেন পাইকপাড়ার এক টেরে আর আমি আমার চোরবাগানের টেরেসে, পরস্পরের টের বিলকুল বাইরে। এধারে পথেঘাটে তাঁর সাথে দেখাসাক্ষাৎ যা ঘটেছে তা দৈবাৎ পথেঘাটেই। আর সাত পাড়া ঠেঙিয়ে ট্রাম-বাসে যাতায়াতের দুর্ভোগ কাটিয়ে পাইকপাড়ায় কে যায়?
আমাদের এলাকায় গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের দোকানের কাছাকাছি একবার তাঁকে দেখেছিলাম কাহিল অবস্থায়। কী হয়েছে, শুধাতে বললেন যে, পাইসে বেজায় কষ্ট পাচ্ছেন। আমি বলেছিলাম, টাকাপয়সা এলেই তা হবে, ঐ আধিব্যাধি। হয় আত্মীয়কুটুমেরা এসে অর্শাবে, নয়তো ঐ অশই। আপনি বোধ করি বেশ উপায় করছেন এখন। আর্নিং পাইলস আফটার পাইলস। শুনে তিনি হেসেছিলেন। কাছাকাছি বিখ্যাত চাঁদসীর মলমের বিজ্ঞাপনদাতা একজনার দোকানে তাঁকে নিয়ে গেছলাম, মনে আছে।
তারপরে এই মাঝে মধ্যেই। তাঁর প্রতিবেশী আমার বন্ধু শৈলজানন্দকে দেখতে যখন গিয়েছি, তখনই যা তাঁর বাড়িত এক-আধটুর জন্য হানা দিতাম–অমরনাথ যাত্রার কালে স্বয়ম্ভু দর্শনে যাবার পথে তীর্থযাত্রী যেমন বদরিকাশ্রম ছুঁয়ে যায়।
সেই সামান্য সংলাপেই যে-পরিচয় পেয়েছিলাম তাতে তাঁর সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি যে, কাউকে খুঁতোনো দূরে থাক, তাঁর কোনো শিঙ-ই আমি দেখতে পাইনি। আর, শিং এবং ল্যাজ এহেন কস্তু, যা থাকলে পরে কিছুতেই তো ঢেকে-টুকে রাখা যায় না। আপনার থেকেই রুখে বেরয়। নিজগুণের প্রকাশ পায়, স্বরূপেই বেরিয়ে পড়ে।
তারাশঙ্করের মুখে কখনো অপর কোন লেখকের নিন্দেমন্দ শুনিনি। এরকম আরেকটি লেখকের কথা এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে, তিনি নারায়ণ গাঙ্গুলি। তাঁর ন্যায় মিষ্টি মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।
যেমন মানুষের মধ্যে লেখক, তেমনি লেখকের মানুষ। দুজনেই এঁরা। এই আশ্চর্য যোগাযোগ খুব কমই নজরে পড়ে। লেখক হওয়া সত্ত্বেও যাদের মানুষ বলে ভাবতে দ্বিধা হয় না।
নারায়ণ গাঙ্গুলির একটি ইডিয়লজি ছিল অবশ্যি, যা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নিয়ে বিরুদ্ধমতি কারো সঙ্গে তর্কাতর্কি বা আঘাত দিয়ে কথা কইতে কোনদিন তাঁকে শুনিনি। বিরোধিতা বা বিরুদ্ধবাদকে মৃদু হেসে সায় দিয়ে যাবার অধ্যবসায় ছিল তাঁর। কোন লেখকের কাছ থেকে এটা যেমন অপ্রত্যাশিত শিষ্ট আচরণ, তেমনি অকল্পনীয় মিষ্ট ব্যবহার। এটাকেই আমি তাঁর মিষ্টতা বলেছি। এর স্বাভাবিক সৌরভ তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। সর্বতোভাবে বিজড়িত ছিল।
তারাশঙ্কর অবশ্যই এমনধারা মিষ্ট নন। ব্যক্তিগত ব্যাপারে কারো প্রতি কোনো তিক্ততা না থাকলেও আদর্শগত ক্ষেত্রে ভিন্নধর্মীর প্রতি বিরূপ-জেহাদীর মতই খঙ্গহস্ত।
সেদিক দিয়ে তিনি বীরভূমের মাটির মতই কড়া–যেমন কঠোরতায় তেমনি তীক্ষ্ণতায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিনিন্দার নীচুস্তরে ব্যক্ত হতে তাঁকে কখনো দেখা যায়নি, আমি তো দেখিনি।
না, পরের ওপর শিঙের ধার পরখ করার শৃঙ্গার তাঁর আচরণে আমি দেখিনি কখনো। কাউকেই তিনি কদাপি গুঁতোতেন না। অন্তর্গত শিঙের অভাবেই সেটা পারতেন না বোধ করি। বরং বলা যায় যে, আমিই তাঁকে একবার গুতিয়ে দিয়েছি–তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে টু মারতে গিয়েছি–সাহিত্যের ক্ষেত্রে যখন চারধারেই আমার টু টু–সেই কারণেই হয়ত বা।
আমার ঢুঙ্কারের জবাবে তিনি চুপ করেছিলেন, নিরুত্তাপ তাঁর সেই নিরুত্তরতার মধ্যেই বুঝি আমার প্রশ্নের উত্তর নিহিত ছিল। তাঁর নিরুক্তির ভেতর দিয়েই সে কথা নিঃশেষে উক্ত হয়েছিল বুঝি বা।
আমার জবাব পেয়েছিলাম কিছুদিন পরেই–তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে। অনির্বচনীয় সেই রচনা।
পাটনার প্রভাতী মাসিকে তাঁর ‘কবি’ বেরুচ্ছিল ধারাবাহিক। কবি পড়ে আমি তো অভিভূত।
ছোট একটুখানি গোষ্পদের গর্ভে যেমন বিপুল আকাশের ছায়া পড়ে, তেমনি অজ পাড়াগাঁর নিরক্ষর এক ছড়াকারের ভেতরে বিরাট কবির ভূমিকা তিনি ধরে দিয়েছেন ওই বইয়ে। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি একাত্ম হয়ে এখানে যেন বিধাতার মতই যুগপৎ মহৎ।
তারাশঙ্করের ভাষার বহিরঙ্গ দেখে আমি ক্ষুব্ধ ছিলাম। তাঁর অন্তরের অন্তরঙ্গ হবার সুযোগ পাইনি এর আগে।
সেটা ছিল প্রমথ চৌধুরীর যুগ। বাংলাসাহিত্যে বীরবলী Spell তখন–চলতি ভাষাই চালু। এক কথায় অনেক কথা বলা, অল্পের মধ্যে বিস্তরের আভাস-ইঙ্গিতবহ আঁটসাঁট তাঁর বাকভঙ্গীর মায়ায় সবাই আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। এমনকি, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাঁর হস্তাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। সেই সময় তারাশঙ্করের এই ফেলে-ছড়িয়ে লেখায়-বহু কথনের বহুলতর বিস্তার আমার কাছে যেন বাহুল্য বলেই বোধ হয়েছিল। বীরবলের ঋজু তির্যক সংক্ষিপ্ত ভাষণের কাছে আর সব ভাষা–সবার ভাষণই নিতান্ত প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে হত।