.
৮২.
কবিরাজ রমেশচন্দ্র সেনের নাতিবৃহৎ ঘরটার উত্তর-পশ্চিম দিকে ছিল তাঁর ওষুধভর্তি আলমারিদেরাজ। ঘরজোড়া প্রকাণ্ড এক তক্তপোষ, সেই তক্তপোষের ওপর কেন্দ্রমণিরূপে তিনি বিরাজ করতেন, তাঁকে ঘিরে বসত সুহৃদ সাহিত্যিক, আর এক কোণে থাকত তাঁর কম্পাউন্ডার আর ছাত্ররা। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে একজনকে আমার মনে আছে আজও, হরিদাসবাবুকে, কবিরাজী ওষুধপত্র পাঁচন মুষ্টিযোগ বানানো ছিল যাঁর কাজ।
সেখানে বসেই রমেশবাবু সাহিত্যিকদের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনার সাথে রোগীদের দেখাশোনা করতেন, প্রার্থী সম্পাদকদের লেখাটেখা দিতেন সেখানেই–সাহিত্যপত্র আর ওষুধপত্রের ব্যবস্থা চলত পাশাপাশি।
রমেশবাবুর সেই তক্ততাউসে সাহিত্যের রাজাগজার থেকে প্রজাখাজা, সবার জন্যেই সমান অভ্যর্থনা ছিল। বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠীর, বাহ্যত যাঁদের সাপে-নেউলের সম্পর্ক, তাঁরা সেই তক্তপোষে এসে আপসে মিলেছেন।
দেয়ালঘেঁষা দেরাজ আলমারির খাপে খাপে কবিরাজখানার দাবাইভর্তি শিশি বোতল বোয়েম সব সাজানো, আসব অরিষ্ট মোদক মাদক বৎ স্বর্ণ রৌপ্য লৌহঘটিত বটিকাদের ঘটা। মাঝখানে সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে দিলদরাজ কবিরাজ-লিখিয়ে রমেশবাবু বিরাজমান। সেখানে বেখাপ্পা কিছু হবার যো ছিল না।
তবু সেখানেই একদিন ছন্দপতন ঘটে গেল।
ছন্নচাড়া এই আমাকে নিয়েই।
তারাশঙ্করবাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ আমার সেখানেই–সেই তক্তপোষের ওপরেই। আর সেই আলাপেই প্রথম ছন্দপাত।
প্রথমালাপটি যে মধুরোচক হয়নি তা বলতেই হয়। প্রথম যোগাযোগই দুর্যোগাযোগ!
পরিচয় হতেই আমি বলে ফেলেছিলাম-আপনার লেখা আমার ভালো লাগে না মশাই! এখনো যদি সেই করিয়া খাইয়াই পড়তে হয় তো দামোদরবাবু কী দোষ করলেন? তাঁর গ্রন্থাবলীই পড়বো না হয়। প্রায় সেই একই ধরনের যদি লেখা হয় তো বঙ্কিমবাবু থেকে কী আপনি এগুলেন? শরৎচন্দ্রের থেকেই বা আপনার স্বাতন্ত্র কোথায়? তাঁদের লেখাই পড়ব বরং আপনার লেখা পড়তে যাব কেন?
তিনি সে-কথার জবাবে কোনো রূঢ়তা প্রকাশ করেননি, জবাব দেননি কিছু, শুধু একটু হেসেছিলেন মাত্র।
বোধ করি তাই ছিল তাঁর জবাব।
সে সময়টায় আমি যেন কেমন ধারাই ছিলাম। পাড়াগাঁর থেকে নিয়ে আসা গ্রাম্যতা আমার গা থেকে যায়নি তখন। কলকাতার সভ্যসমাজের আওতায় এসে তার নাগরিকতার ছোঁয়া লাগেনি। তেমন সভ্যভব্য হয়নি তখনো। প্রায় জলই ছিলাম একরকম।
তাছাড়া উঠতি বয়সটারই কেমন যেন একটা নেশা আছে। যে নেশার বিভ্রমে সহজেই ধরাকে সরা জ্ঞান করা যায়।
সে বয়সের দাপটে নওজোয়ানরা দাড়ির স্বকপোলকল্পনায় সাধ করে নিজের গালে বার বার ক্ষুরের চোট খায়, আর নয়া বাছুররা তার শক্তিমত্তা ফলাতে চায় ক্ষুর তুলে, এমন কি বনস্পতির গোড়াতেও গিয়ে টু মারতে কসুর করে না। শিঙ গজাবার মুখে তাদের কপাল বোধহয় সুড় সুড় করে আনাদ ছাড়বার গোড়ায়। (এই হেই বুঝি সুকুমার রায় গানে আর গুতোয় একাকার করে ফেলেছিলেন। ঠিক তেমন ধারাই হয়ত নয়ালিখিয়েরা নিজের বলবত্তা ফলাও করতে বাছবিচার না করে চোট মারতে যায় সবাইকে–গোত্তা মেরেই আরাম পায় বোধ হয়। শিঙ বেরোবার আগে সেটাই বোধ হয় তাদের এক রকমের শৃঙ্গার।
আমিও তেমনি সবাইকে তখন ধরে ধরে গুতিয়ে দিতে শুরু করেছিলাম–উল্লেখ কাউকেই আমার তিরিক্ষে লেখনী রেহাই দেয়নি তখন। রবীন্দ্রনাথ, শ্রীঅরবিন্দ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, শিশির ভাদুড়ি কাকে না? (আমার মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী বইয়ে মস্করার ছলে তাঁদের সেই সপিণ্ডকরণের সবিশেষ সবিস্তারে উল্লেখিত।) জুতসই করে কাউকে মজুতসই গুঁতো মারাটার কেমনতর মজা আছে যেন। তরুণ বয়সীর কাছে সেটা বাহাদুরি বলেই মনে না।
সেই বাহাদুরির বাহুল্যই তারাশঙ্করের কাছে ফলানো আমার।
তিনি আমার প্রগম্ভতার কোন প্রতিবাদ করেননি, প্রত্যাঘাতও না।
কিন্তু এক বালকের মুখে আমার কথাটার প্রতিধ্বনি শুনে অপ্রস্তুত হতে হয়েছিল আমাকে একটু বাদেই–ঐখানেই।
একটি ছেলে তাদের বাড়ির কার ওষুধ নিতে এসেছিল রমেশবাবুর কাছে। কৌতুক করার মতলবেই হয়ত ছেলেটিকে তিনি শুধিয়েছিলেন-তারাশঙ্করবাবুর লেখা তুমি পড়েছে? কেমন লাগে তোমার?
ততটা ভালো লাগে না। বোধ হয় বুঝতে পারি না বলেই।
আর শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা?
দারুণ দারুণ! ভীষণ ভাল্লাগে আমার।
ওদের কাউকে তুমি চেন কি?
একদম না।
তখনো দেখলাম তারাশঙ্করবাবুর মুখে সেই মৃদু হাসি। একটুও অপ্রতিভ হয়নি তার কথায়।
অপ্রস্তুত হতে হয়েছে আমাকেই। আমি তার কথার প্রতিবাদ না করে পারিনি-বড় হও। বড় হয়ে তুমি তারাশঙ্করবাবুর লেখা পড়ো, তখন বুঝবে কাঁচের সঙ্গে হীরের কী তফাত। তোমার বয়সের ছেলেরা চাকচিক্যে ভোলে। কিন্তু জানো তো, অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ নট গোল্ড? যখন তুমি তারাশঙ্করের লেখা বুঝবে, তখন ওই শিব্রামের লেখা তোমার একটুও ভাল্লাগবে না।
ছেলেটা অপ্রসন্ন মুখে আমার উপদেশ আর রমেশবাবুর ওষুধ নিয়ে চলে গেল।
একটু আগেই নিজের কথার প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়ে আমি ঈষৎ অপ্রতিভ হলেও তারাশঙ্কর কিন্তু তেমনি সপ্রতিভ। তাঁর মুখে সেই মৃদু হাসিই।
লেখকে লেখকে লেখার তারতম্য, মতামতে পার্থক্য, ব্যক্তিত্বের উনিশ-বিশ থাকেই, কিন্তু তা হলেও আমি বলব, লেখকরা পরস্পরের কাছে বিষতুল্যই। মুখে মধুর হলেও পরস্পরের প্রতি তাঁরা বিষিয়ে রয়েছেন সর্বদাই।