কিন্তু পকেট ভর্তি টাকা ছিল, কোনো বড় রেস্তোরাঁয় গিয়ে পেট ভর্তি করব বলেই যে। ও-কথা বলেছিলাম তা নয়, মূলতঃ পরের বাড়ি কিছু খাবার মানাই ছিল আমার মার।
দেশে থাকতে বামুন পাড়ায় গিয়ে কারো বাড়ি যদি কোনোদিন কিছু আমি খেয়ে আসতাম, জানতে পারলে মা রাগ করতেন। বলতেন, খানে আর। পরের বাড়ি এমন করে খেলে লোকে বলবে লেলটিয়া।
লেলটিয়া কী? তার মানে আমি আজও জানিনে। হ্যাংলামি আর পেটুকপনা দুই মিলিয়েই হয়ত মার ঐ কথাটার অর্থ হবে–তাঁর আশ্চর্য বাগৈশ্বর্যর পরিচয়।
কিন্তু ঐ লেলটিয়া হবার ভয়েই আমি অনেক দিন কারো বাড়ি কোথাও কিছু খাইনি।
আসলে মা আমার তেমন কিছু রাঁধতে জানতেন না–সেটা আমি টের পেলাম গৌরাঙ্গর মার রান্না খাবার পরই। উনি এক ইলিশ মাছকে সাত পাকে সাত রকমের বেঁধে ধ্রুপদী রান্নার সা রে গা মা পা ধা নি সাধতেন যেন! রন্ধনকলার অমন কালোয়াতি আর কোথাও আমি দেখিনি।
আমার মা রাঁধতে পারতেন মোটামুটি। ঐ ডাল ভাত আর মাছের ঝোল চচ্চড়ি আলু ভাতে লুচি সিঙ্গারা আলুর দম এই সব। আমাদের মুখে তাই অবশ্যি অমৃত বলে ঠাওর হত।
কিন্তু জানতেন যে, তিনি মোটেই রাঁধতে জানেন না। অন্য কারো বাড়ি খেয়ে পাছে আমরা টের পেয়ে যাই আর তাঁর হাতছাড়া হই, সেটা বোধহয় তিনি চাইতেন না।
ওই লেলটিয়ামির ভয় দেখাতেন তাই। পাছে আমরা অন্য কারো রান্না খেয়ে তার রান্নায় অরুচি দেখাই! অপর কারো রান্না খেয়ে পর হয়ে যায় নিজের ছেলে-কেমন পেটসর্বস্ব যে আমি জানতেন তো ভালই–আরো ভালো খাইয়ে কোনো পরের মা-ই আমার কাছে পরমা হয়ে ওঠে–আমি তার খপ্পরে গিয়ে পড়ি আর বেহাত হয়ে যাই, সেই ভয়ে আর ঈর্ষাতেই তিনি ছেলেকে নিজের ঘরে বেঁধে রাখতে চাইতেন হয়ত।
বাঃ! আজ আমার জন্মদিন যে! খাবেন না আপনি? বলেছিল গোরা।
জন্মদিন যে কী বস্তু, তাও আমি ভালো করে জানিনে তখন। কেন যে তা অবশ্য পালনীয়–এবং সেটা যে চৰ্য্য চোষ্য খেয়েই, তাও আমার জানা ছিল না। আমার জন্মতিথি কোনোদিনই পালিত হয়নি, নিজের জন্মতারিখই জানা ছিল না আমার।
জন্মদিন তোমার? তাই নাকি? তাহলে তো খেতেই হয়। বলেছিলাম, আর খেয়েও ছিলাম তারপর।
খেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আড়ালে ওকে শুধিয়েছি, এইরকম খাও নাকি হে তোমরা রোজ? রোজ রোজ?
তা, প্রায় রোজই। বাবা খেতে খুব ভালবাসেন। নিজে বাজার করেন। পাঁচ সাত রকমের মাছ মাংস কিনে আনেন রোজ-সে বলেছিল।
তারপর আর বলতে হয়নি। তারপরে প্রায় রোজই ওদের বাড়ি গিয়ে খেয়েছি। কারণে অকারণে। থেকেওছি। ওর মা যেমন নানা রকমের রাঁধতে ভালোবাসেন, তেমনি প্রাণভরে ভালোবাসতেন খাওয়াতে সবাইকে। কিন্তু গোরারই নয় কেবল, সেই দিনটি আমারও জন্মদিন ছিল বোধহয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর গোরার মা ওর কপালে চন্দনের তিলক পরিয়ে ওকে আদর করলেন একটুখানি।
গোরা বলল, শিব্রামবাবুকে খেলে না?
.
বারো-তেরো বছরের রহস্যময় বয়সে ছেলেরা যেন অলৌকিকতার রসে লীলায়িত থাকে। এই ধরনের অসম্ভব কথা কয়ে একেক সময়ে অবাক করে দেয় সবাইকে।
ছেলের অদ্ভুত আবদার বাধ্য হয়ে রাখতে হয় মাকে। কপালের ওপর আলতো একটুখানি ছোঁয়া পাই, সেইখানে-যেখানটি ছুঁয়ে আমার মা আরেক কোন্ মায়ের সঙ্গে–যিনি নাকি আমার মা, তোমার মা–সবার মা–সেই জগন্মাতাই!–যোগাযোগ ঘটিয়েছিলেন সব প্রথম।
আরেক আঁচের ছোঁয়াচ লাগা সেই প্রথম দিনটির মতই আমি শিহরিত হই।
আর সঙ্গে সঙ্গেই আমারও নবজন্মলাভ হোলো সেদিন। সেই মুহূর্তে। উনিও আমাকে ছেলের মত গ্রহণ করলেন, আর আমিও সেইখানে সেইক্ষণেই নিজের মায়ের স্থলে তাঁকে বরণ করে নিলাম। তারপর থেকে বরাবরই তাঁকে আমি মা বলেই ডেকে এসেছি। আর তার ফলে কেবল মা, ভাই বা বন্ধুই নয়, যা আমার ছিল না, তিনকুলে ভাইফোঁটা দেবার ছিল না কেউ, সেই আমার মায়ের পেটের বোনের মতন পেলাম কজনকে। আমার বোনের চেয়ে বড়ো, বন্ধুর মতও বলা যায়, তাদের পেয়ে গেলাম তারপরই ডাকামে যারা জবা, জানু, পুতুল, ইতু, ভুতু–আর নামড়াকে যমুনা, জাহ্নবী, সরস্বতী, কৃষ্ণ, কাবেরী ইত্যাদি।
সত্যি বলতে, ওদের বাড়ি এসে ওদের সঙ্গে মিশেই আমি মানুষ হলাম বলা যায়। দেশের থেকে এসেছিলাম প্রায় জংলীর মতই। সেকালের গেয়ো ছেলেরা হোতো যেমন। কালচার-ফালচারের ধার ধারতাম না, জানতামও না কিছু।
মা-বাবার সংস্কৃতজ্ঞান থাকলেও সংস্কৃতির জ্ঞান ছিল না। সংস্কৃতি অবশ্যই ছিল একটা তাঁদের, কিন্তু সেটা নেহাত সেকেলে-একেবারে আলাদা ধরনের। আর কলকাতায় এসে আমার সংস্কৃতির দৌড় যা ছিল, তা ওই জেলেপাড়ার সং পর্যন্তই। এমনকি, আমি নিয়মিত চুল ছাঁটতেও জানতাম না তখন। ঝাঁকড়া রুক্ষ চুলভরা থাকত মাথা, কাজীর মত সুবিন্যস্ত নয়, বুনো ঘাসের মতই–সেই চুলের গোছা উপচে এসে পড়ত কপালের ওপর-শৈলবাবুর আঁকা সেকালের আমার গল্পের ছবিতে যেমনটা দেখা যায়। গোরার পাল্লায় পড়ে সেদিনই। ওদের পাড়ার সেলুনে গিয়ে চুল ছাঁটলাম, সামনের চুলগুলো যেন না কাটে, অমনিই থাকে, একচুল এদিক-ওদিক না হয়–পেছনে যেমন খুসি ছাঁটুক–পরমানিককে সকাতর এই অনুনয় জানিয়ে। ফলে চেহারাটা ওরই ভেতর একটু ভদ্রগোছের হোলা বলতে কি! দেশের থেকে জংলির মত এসে ওই সাংস্কৃতিক পরিবেশে গোরাদের বাড়িতেই খেয়ে পড়ে আমি মানুষ হয়েছি, বলব আমি। গোরার বাড়ি খেয়ে আর ওর মামার লাইব্রেরির যতো বই না পড়ে–যা কিছু আমার বিদ্যে, শিক্ষালাভ আর কৃষ্টিপ্রাপ্তি! ওদের ঋণ আমার এ জীবনে শুধবার না। আর ওদের স্নেহপ্রীতি-তাই কি শুধতে পারব কখনো? ওর মা সবার প্রতিই সমান স্নেহার্টু, সাক্ষাৎ মাতৃরূপা। কিন্তু তাছাড়াও, আমার জীবনের ঊষর মরুভূমির ওপর দিয়ে যে কল্পনদীরা বয়ে গেল…যমুনা, জাহ্নবী, সরস্বতী, কৃষ্ণ, কাবেরী…জবা জানু পুতুল ইতু ভুতু…ইত্যাদির ঋণ আমি কি শুধতে পারব কোনদিনই? আমার প্রায় বইয়েই–সেই আই-এ-পির থেকে ইদানিং আনন্দ পাবলিশার্সের প্রকাশনায়–নিখরচায় জলযোগ-এর থেকে ভালোবাসার অনেক নাম পর্যন্ত বইয়ে ওদের কাহিনী ছড়িয়ে আছে–এই স্মৃতিচারণায় তার পুনরুক্তি করতে চাইনে। কিন্তু সেই প্রবাহিনীর থেকে আমার কৃষিক্ষেত্রেও যে সোনার ফসল আমি তুললাম জীবনভোর…ক্ষণে ক্ষণেই মুহুর্মুহু যে আমার নব নব জন্মলাভ হোলোলা…আমার পতিত ইয়ে যে সোনা ফললো স্পর্শমণির সেই ছোঁয়ায়, তার মর্মকথা কি আমার গল্পগাথায় বলতে পেরেছি।