পড়বার দরকার করে না। ছেলেদের লেখার, বুঝেছেন, ছেলেরাই বেস্ট জাজ। গোরার যখন ভালো লেগেছে, তখন আর সব ছেলেরই ভালো লাগবে ধরে নেওয়া যায়।
তাহলেও একবার পড়ে দেখার দরকার বোধ হয়। আপনি অব ঠাকুর প্রভৃতির বই ছেপেছেন বলছিলেন না…আমার লেখাটা সেই দরের হয়েছে কিনা দেখুন আগে…
সেই দরের কী করে হবে? তা কী হয়? তাঁর মন কি কেউ লিখতে পারে কখনো? বলে একটু হাসলেন, আমার প্রগভতায় হয়ত বা–তবে আপনার বইটা কাল রাত্রিরেই পড়ে আমি শেষ করেছি, বলতেই গোরা তার রামধনুর কপিগুলো দিয়েছিল আমাকে। খুব উঁচুদরের না হলেও, বেশ বই, বলব আমি।
তার পরে আর আমি কী বলতে পারি? চুপ করে থাকি।
তিনি বললেন, দেখুন, মোটমাট শ পাঁচেক টাকা দেব আমি আপনাকে। আপনি রাজী?
নিশ্চয়। কপি রাইটের জন্য আমি যথেষ্ট মনে করি।
মুখে বলি, আর মনে লাফিয়ে উঠি। আমার লেখকদশার সেই প্রাক্কালে পঞ্চাশ থেকে একশো টাকায় কপিরাইট বেচি তখন, সেই সময়ে অতগুলো টাকা আমার কাছে প্রায় যেন ছপ্পর ফেটে পড়বার মতই।
এটা আপনার প্রথম সংস্করণের জন্যই। তিনি জানালেন তারপর।
কপিরাইট নেবেন না আপনি? আমিওতেই আপনি কপিরাইট পেয়ে যেতেন কিন্তু।
না, কপিরাইট কিসের! কপিরাইট আপনারই রইলো। পরের সংস্করণে আবার আপনি পাঁচশো টাকাই পাবেন আমার কাছে। বুঝেচেন? বু
ঝতে আমার সময় লাগে। বিস্ময় জাগে।
কিন্তু বিস্মিত হবার কিছু ছিল না। উচ্চশিক্ষিত, উঁচু ঘরের ছেলে, উঁচুদরের লিখিয়ে নিজেও–তখনই প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত কিশোর পত্রিকা রমশালে খেয়ার মাঝি লক্ষ্মীনাথ বলে তাঁর একটি অবিস্মরণীয় লেখা বেরিয়ে সাহিত্যিকমহলে সোরগোল তুলেছিল (সেই গল্পটা আরো নানা গল্পের সঙ্গে বই হয়ে বেরিয়েছে এতদিন বাদে–এম. সি. সরকার থেকেই সম্প্রতি-মৌচাকের বিজ্ঞাপন পাঠে জানলাম ) সুতরাং লেখার মান তিনি ভালোই জানেন, আর লেখকের উপযুক্ত মর্যাদা দিতেও তাঁর কুণ্ঠা হবার কথা নয়। একটি উচ্চমনা অভিজাতবংশের তরুণের কাছে সেইটাই আশা করা যায়।
কিন্তু আভিজাত্য আর ব্যবসা-বুদ্ধি বোধহয় হাত ধরাধরি করে চলে না। জ্যোতিঠাকুরের জাহাজী কারবার থেকে শুরু করে সুরেনঠাকুরের বীমা ব্যবসায় জেরবার হওয়া পর্যন্ত এইটেই দেখা গেছে, সতীকান্তবাবুর বেলাও তার অন্যথা হবার কথা নয়।
লেখার এবং লেখকের মানছত্র বাড়াতে গিয়ে তাঁর প্রকাশনা-মন্দিরের দানছত্র উঠে গেল দুদিনেই–গ্রন্থবিহার চলল না বেশিদিন। ভেঙে পড়ল দেখতে না দেখতে।
বিহারের সেই দারুণ ভূমিকম্প তার জন্য দায়ী কিনা আমি বলতে পারব না।
৮. বরাত খুলল
৮১.
যার হেতু আমার এই বরাত খুলল, সেই গোরার সঙ্গেও আলাপ হল আমার তার পর।
কিন্তু গোরা যে আমার বই নেবার জন্য তার মামাকে ধরবে এটা একটুও বিস্মিত করেনি আমাকে। কেননা, চিরকাল ধরেই এরকমটা আমি দেখে আসছি। পড়েননি, আমার বই, ছাপাতেও তেমন আগ্রহী নন, আমি কেমন লেখক তাও তাঁদের জানা নেই, নেহাত তাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ধরে বসেছে বলেই সেই নাছোড়বান্দা দায় এড়াতেই প্রকাশকরা আমার দায়-পরিগ্রহ করেছেন, পরেও আমি দেখেছিলাম।
গোরার থেকে আরম্ভ হলেও আমার লেখক জীবনের আগাগোড়াই এই কাণ্ড!
অতই ছিল-গোরা সেই বাল্যকালেই। কাস্টারড়, কিন্তু শুধু তাই নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল সে। আশ্চর্য ছিল তার কথাবার্তা–প্রায় সমবয়সী সমকক্ষের মতই ছিল তার আচার-আচরণ। প্রেমেন থেকে বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত তাবড়ো বড়ো লেখকদের সবাইকেই সে অবাক করে দিয়েছিল প্রথম চোটেই। বয়সে অতো ছোট হয়েও সে ছিল সবার বয়স্যের মতই।
অদ্ভুত ছিল তার পড়াশোনা। তার মামার ঘরোয়া পাঠাগারের ঘরভর্তি যতো বই-ইংরেজিই তার বেশির ভাগ–সে পড়ে শেষ করেছিল সেই বয়সেই। তার কাছেই আমি ডিকেসের খবর পাই, কান ডায়েলের-মার্ক টোয়েনের। আরো অনেকেরই। বিশ্বসাহিত্যের পরিচয় লাভ আমার তার সৌজন্যেই। এদিক দিয়ে তার কাছে আমি অশেষ ঋণী।
যেমন পড়ুয়া ছিল, তেমনি গল্পও লিখতে পারত সে। চমৎকার লিখত। তখনই তার কয়েকটা গল্প রামধনু ইত্যাদি পত্রিকায় বেরিয়েছে। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি ছোটদের গল্পের তার এই অপরূপ বইটি, শৈল চক্রবর্তী বিচিত্রিত হয়ে তার ইস্কুলের পঠদ্দশাতেই প্রকাশ পায়। ইস্টার্ন ল হাউস-আরতি এজেন্সির অনাথ দে মশাই, মন্টুর মাষ্টার ইত্যাদি আরো কী কী বই বার করেছিলেন–তার সঙ্গে আমারও সেই সময়েই।
গোরা আমায় তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। গোরার বাবা যাদবেন্দ্রবাবু আলিপুরের অ্যাডভোকেট, ভারিক্কী মানুষ ছিলেন, বেশি কথা কইতেন না, কিন্তু তার মা সস্নেহে আমায় গ্রহণ করলেন। নিজের ছেলের মতই।
অমন পরমাশ্চর্য মহিলা আমি জীবনে দেখিনি। মহিয়সী বললে কিছুই তাঁর বলা হয় না। সহজ আভিজাত্য তো ছিলই, তার চেয়েও বড় ছিল তাঁর মাতৃসত্তা। সেই মাতৃবত্তা–যা আমি কেবল মার মধ্যেই দেখেছিলাম। ভাষায় যা প্রকাশ করা যায় না।
তিনি আমায় বললেন, এখানেই দুটি খেয়ে যাবে আজকেমন?
আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, বাসার থেকে খেয়ে বেরিয়েছি যে! ঘুম থেকে উঠেই আমার খিদে পায়, আর খিদে পেলেই খাই। খালিপেটে থাকতে পারিনে। বেশ, আর একদিন খাব না হয়।