অসুবিধায় না পড়লে আমার হত কী? দায়ে পড়লেই তো লিখি। টাকার ধান্দায় বেরেই। টাকা পাই–টাকা পেলেই গিলে বসি, সে টাকা আর ওগরাতে পারব না জেনেই বাধ্য হয়ে লিখতে হয় তখন। নইলে টাকা থাকতে আমায় লেখায় কে? স্বভাবের বশে নয় ভাই, নেহাত অভাবে পড়েই লেখাটেখা আমার-বুঝেছিস?
এই জন্যেই কোনোদিন তোমার কিছু হয় না। লেখারও উচিত দাম তুমি পাও না কোনোদিন। যে যা দেয়, দায়ে পড়ে তাই নিতে হয় তোমায়। সম্পাদক প্রকাশকরা মওকা পেয়ে যায়। তোমার পকেট যে গড়ের মাঠ, সেটা টের পেতে দেরি হয় না কারো। তোমার মুখেই তার লক্ষণ প্রকট হয়ে পড়ে।
গড়ের মাঠের মল ঘাস গজায় বুঝি? মনের দুঃখে দাড়ি কামাইনে বলে বলছিস তাই?
খাঁকতির মাথায় যাও বলেই যার যা খুশি দেয়, হাসিমুখে তাই নিয়ে আসতে হয় তোমায়। যে টাকায় অন্যরা সব এডিশন দেয়, তাই পেয়ে তুমি কপি রাইট বেচে নাচতে নাচতে আসো। নিজের মাথা নিজেই খাচ্ছে। একটা সংস্করণ স্বত্ব বেচেই প্রেমেনদা কতো বেশি পান তোমার চেয়ে, তা জানো? তার একটা বইয়ের দাম তিন টাকা চার টাকা, আর তোমার চার আনা ছ আনা। দিনকের দিন বাজারদর কমে যাচ্ছে তোমার।
ঘরে ঘরে আদর বাড়ছে তেমনি। কপি রাইট বেচে দি বলেই না আমার বইয়ের দাম অতো সস্তা? ছেলেমেয়েরা কিনতে পারে কত সহজে?
বাজারদরের সঙ্গে ছোটদের আদর মিলিয়ে লাভ-ক্ষতিটা আমার কতখানি দাঁড়ায় খতিয়ে দেখি, দেখাতে চাই।
আদর আমার মাথায় থাক। আদর নিয়ে কি ধুয়ে খাব? আদর খেয়ে কি বাঁচবে তুমি? সে ঝামটা দেয় : আর পাঁচ দশ টাকার গল্প বেচে আসো যে পত্রিকায়, তার কী? সেটা ওই টানাটানির মুখে যাও বলেই না? আগের থেকে লিখে রাখলে তারা এসে টাকা দিয়ে তোমার লেখা নিয়ে যেতে পারে–ভালো দামও পাও তাহলে। তা করো না বলেই তাই আগাম ওই নামমাত্র দাদন দিয়ে তারা লিখিয়ে নেয় তোমাকে দিয়ে।–বিনি কয়-কেন, তোমার আগে থাকতে অবসর মতন লিখে রাখতে কী হয়?
কী হয় কে জানে। মোটের ওপর খুব ভালো হয় না। সেই পঞ্জীভূত লেখা তখন দায় হয়ে দাঁড়ায়। মাথা খারাপ করে দেয়। মন ভারি হয়ে থাকে। অবিবাহিতা মেয়েকে যেমন পাত্রস্থ করতেই হয়, অপ্রকাশিত লেখাদেরও তেমনি পাত্রস্থ না করে রেহাই নেই–মনের ভেতর তারা আঁকুপাঁকু করতে থাকে কেমন! না ছাপানো পর্যন্ত ভাই, আমার ভালোলাগে না, স্বস্তি পাই না। কন্যাদায়ের মতই সে এক নিদারুণ দায়। ছোটাছুটি করো তখন, সম্পাদকদের বাড়ি বাড়ি-সে এক বেজায় ঝকমারি। আমার পোযায় না।
আর সব লিখিয়েরা তবে কাঁড়ি কাঁড়ি লিখে জমায় কি করে? এক সাথে বাজারে চার-পাঁচখানা করে বই ছাড়ে যে…?
আমার কাছে সেটা রহস্যই সত্যি! অভাবে পড়ে লেখে না, স্বভাবের তোড়ে লিখে যায়-সরস্বতীর বরপুত্র তারা নিশ্চয়। লিখে তারা আনন্দ পায়, লেখে তাই। লেখার জন্য তাদের কোনো প্রাণের দায় নেই–কেবল ঐ প্রেরণার ঘাঁই! চুনোপুটির মৎস্য অবতাররণা তাঁদের জালে পড়ে বরাহ হয়ে ওঠেন, একটা ছোট্ট গল্পের মতন এতটুকু প্রাণীকে কী করে তাঁরা রাঘব বোয়ালের ন্যায় উপন্যাসে বাড়িয়ে ছাড়েন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করার মতই।
যাকে তন্নিষ্ঠ লেখক বলে, এঁরা বোধ হয় তাই। সর্বদাই তাঁরা লেখেন, না লিখে যেন নিস্তার নেই–কিছু না কিছু লিখছেনই সব সময়। সকালে উঠেই খেয়ে না খেয়ে লিখতে বসেন–খেয়েদেয়েও তা শেষ হবার নামটি নেই–লিখেই যাচ্ছেন। লেখাটাই তাঁদের খোরাক, লেখার খাই কখনই তাঁদের মেটে না। মিটবার নয়।
কিন্তু এই তন্নিষ্ঠ লেখকদের মত লেখার সঙ্গে অমন ঘনিষ্ঠ হওয়া আমার পোয় না। অতটা পরিশ্রম-লেখার জন্য কখনই নয়, পারলে পরে পরীদের জন্যই হয়ত করা যায়। সেই শ্রমস্বীকারের পারিতোষিক আছে। পরিতুষ্ট হওয়া যায়। কিন্তু লেখার জন্য বদ্ধপরির হওয়া আমার কর্ম নয়।
পরমহংসদেব বলেছিলেন না, যার পেটে যেমনটা সয়? তার জন্য মার সেই রকরে ব্যবস্থাই? মা সরস্বতীরও তাই। তাঁর বড় পুত্রের জন্যই যত তাঁর বাড় বাড়ন্ত! এক অন্ন আর একান্ন ব্যঞ্জন। মেজ সেজ ছোটদের জন্যও তেমনি বিধি, বরাদ্দ–বিরিয়ানির থেকে কোপ্তা কাবাব কালিয়া পোলাও শিককাবাব-যার যেটি চাই। কারো কারো পিঠে পায়েস-খান না তাঁরা আয়েস করে। কিন্তু তারও পরে তাঁর আরো পুত্র থাকে তো; তাঁর ন-রাঙ্গা–নানান। আমি তাঁর সেই ন-পুত্ৰই, কিংবা হয়ত ঐ ত্যজ্যপুত্রই হব বোধ হয়। আমার বরাতে তাই ওই কাঁচকলাই।
তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। পেটরোগা আমি তাই খেয়েই বেশ মোটা।
রিনিকে আমি সেই কথাই বালাই।
আর বেশি ব্যাখ্যানায় কাজ নেই। তুমি যে একটি কুড়ের বাদশা, জানি আমি।
রাজবাড়ির গোলাম প্রায় রাজতুল্যই জানি, কিন্তু তা হওয়ার চেয়ে কুঁড়েঘরের বাদশা হওয়া ঢের ভালো, আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে বাইরে একটা মোটরের হর্ন শুনেই না, ওর কোনো সহপাঠিনীর ঘন্টাধ্বনি হবে হয়ত, নিজের ভ্যানিটি দেখিয়ে ব্যগ্রভাবে বন্ধুর পথযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে–আমার জবাবের কোনো অপেক্ষা না করেই।
আমার অসুবিধা মতন পরদিন সকালেই সতীকান্তবাবুর বাড়ি গেলাম-রামধনুর ফাইল কপিগুলি সমেত।
ফাইলটা তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, পড়ে দেখুন আগে, নেবার মতন কি না।