অচিন্ত্য মুনসেফ তখন। সেই মুনসেফির সেফটি ভালব, স্বভাবসুলভ বিচারবুদ্ধিই তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
আর বুদ্ধদেব বেঁচেছেন নিজের সহজাত প্রতিভায়। এঁদের সকলেই সপ্রতিভ হলেও বুদ্ধদেবের প্রতিভা আবার ডবল তো। নিজের প্রতিভা এবং আরো নিজের। প্রতিভার স্কোয়ার রুট স্বভাবতই প্রবল। সেই চৌকস প্রতিভাই তাঁকে বাঁচিয়েছিল বলে আমার ধারণা। বুদ্ধদেব যদি প্রতিভাবলে বেঁচে থাকেন তো অচিন্ত্য বেঁচেছেন দৈব বলে–তার পরম পৌরুষে। সেটা নিজের পুরুষকারও হতে পারে, আবার পরম পুরুষের দৈবী কৃপা হওয়াও অসম্ভব নয়।
পরমহংসদেব কোথায় যেন বলেছিলেন না যে, বাঘ যাকে ধরে তাকে অন্য কারো ধরবার মতন কিছু আর বাকী রাখে না, তাকে একেবারেই অপরের ধর্তব্যের বাইরে নিয়ে যায় সে।
বিবেকানন্দ আর শ্রী-মর পর যাঁকে তিনি নিজের প্রচারবাহনরূপে চিহ্নিত করে রেখেছেন, তাঁর সেই দাগা দেওয়ার ওপর আর কেউ এসে দাগা বোলায় এমন সাধ্য কার?
তাই তাঁর ওপর দাগাবাজি করাটা একটু অচিন্তনীয়ই নয় কি?
.
৮০.
কবিরাজ রমেশচন্দ্র সেনের আখড়ায় পবিত্রবাবুই ছিলেন সবচেয়ে পালোয়ান, আখেরই একদিন টের পেলাম।
আমাদের গোটা গ্যাং-এর ভেতর উনিই ছিলেন গুলির মত জোরালো আর জবরদস্ত, জেনেছিলাম অচিরেই। ওঁর বাহুর মাস্তুলগুলি বুলেটের মতন ডাক দিয়ে সেই কথাই বলত। তার বেয়ারিং ধাক্কা কোনোদিন পোহাতে হলে যে ডবল চার্জ দিতে আমায়, সেটাও বুঝতে দেরি হয়নি। ডবল মাশুলে উসুল দিয়ে সেটা সমঝেছিলাম একদিন।
পবিত্র গাঙ্গুলি আর রমেশ সেন সগোত্র ছিলেন একদিক দিয়ে। যেমন সাহিত্যসেবী তেমনি সাহিত্যিক-সেবক দুজনেই। নিজের দিকে না তাকিয়ে আগ বাড়িয়ে বাণীর সাধকদের সাহায্যে লাগা–বিশেষ করে সতীর্থদের মধ্যে যারা নবাগত-এই যেন কাজ ছিল দুজনের। একাধিক লেখকদের প্রতিষ্ঠ করতে নানাদিক থেকে তাঁরা সহায়তা করেছেন।
প্রবাসী থেকে শুরু করে নানান পত্র-পত্রিকায়, নজরল যখন কারারুদ্ধ, তার কবিতা / প্রকাশের সাথে নগদ দক্ষিনার উপায় করে সেই টাকা জেলখানায় কাজীকে পৌঁছে দিয়ে আসার পবিত্র কাহিনী তো অনেকেরই জানা। তিনি কেবল নজরুলেরই কাজের কাজী ছিলেন না, কাজীর মত অনেকেরই কাজে লেগেছিলেন।
আমার কোনো কাজে না লাগলেও আমাকেই ধরে লাগাবার কাজটা তাঁর নিজের হাতে নিলেন একদিন-সাহিত্য-কসরতের সেন মশায়ের সেই পালোয়ানি আখড়ায় হাতাহাতি হয়ে প্রায় হতাহত হবার সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা একদিন। আখেরে কী হত কে জানে, নেহাত আমার পলায়নী মনোবৃত্তির দরুনই তার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি সে যাত্রায়।
আবার রাতারাতি কিছু প্রাপ্তিযোগের নগদ নারায়ণ লাভের দাঁওয়ের মওকাও আমি সেইখানেই পাই।
সতীকাত গুহর সহিত সাক্ষাৎলাভ আমার সেখানেই। পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি। বলেছিলেন-আপনিই শিবরাম চক্রবর্তী বটে? আমার ভাগনে গোরা তত মশাই আপনার নামেই অজ্ঞান!
নামেই অজ্ঞান? যতই অজ্ঞানী বালক হোক না, একজন নামমাত্র লেখকের পক্ষে এমন খবরটা হতজ্ঞান দ্বার মতই।
আমি তো মশাই আপনার কোনো লেখাই পড়িনি এখনো, কিন্তু সে বলে যে, আপনার নতুন লৈখক নাকি হয় না। আপনিই নাকি বাংলা সাহিত্যের একমাত্র লেখক এখন।
একটুখানি বাড়িয়ে বলেছে। একমাত্র না হলেও একমাত্রায় নয়, তাতে ভুল নেই। লজ্জিত হয়ে আমি বলি।
সম্প্রতি আমি একটা পাবলিশিং হাউস করেছি গ্রস্থবিহার নামে কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে, ডি, এম, লাইব্রেরীর ঠিক পাশেই। দেবার মতো আপনার কোনো বই থাকলে দিতে পারেন আমাকে। গোরার খুব ইচ্ছে আপনার একটা বই আমরা বার করি। আছে কি কোনো বই আনার?
রামধনু-তে আমার একটা উপন্যাস শেষ হয়েছে সেদিন। ছোটদের উপন্যাস-বাড়ি থেকে পালিয়ে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই বইটার কথাই বলছিল বটে। বলছিল যে, অমন বই নাকি…যা সে-কথা, ওটার ফাইল কপিগুলো নিয়ে একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি, এই সম্পর্কে কথা হবে।
বলে নিজের বাড়ির ঠিকানা জানালেন। ইন্দ্র রায় রোডের দশ নম্বর বাড়িতে তখন ওঁরা থাকতেন।
কবে যাব বলুন? আমি জিজ্ঞেস করি : কখন গেলে আপনার সুবিধে?
যে কোনদিন সকালে। সকালেই সুবিধে। তখন গেলে গোরার সঙ্গেও আলাপ হবে আপনার। সামনের বাড়িতেই থাকে ওরা। যেদিন আনার সুবিধা হয়, আপনার সুবিধামতই যাবেন।
আমার সুবিধে মত? কথাটায় আমার হাসি পায়। হায়, আমার সুবিধে মতন কিছুই যে আমার হয় না। এমন কি, আমার লেখাটেখাও হবার নয়।
সব কিছুই আমার অসুবিধা মতন হয়ে থাকে। এমন কি ঐ লেখাটেখাও। কোনো প্রেরণার দায়ে নয়, খুব অসুবিধায় পড়লেই লেখারা পায় আমায়। সৃজনৈষণার বশে নয়, নিতান্ত দায়ে ঠেকলেই লিখতে বসি। লেখা বেরয় আমার।
টাকার দরকার না পড়লে লেখার মর্জি হয় না। গরজই হয় না আমার। টাকার জন্যই লিখি, লিখে থাকি, লিখছি চিরটা কাল।
আর অসুবিধা আমার সব সময়। অসুবিধায় পড়লেই আমার সব হয়। লেখা হয়, টাকা হয়, সব কিছুই। আমি জোটাই আবার আপনার থেকেও জুটে যায়। কী করে যে এই জট পাকায় কি জানি। মহাকালের জটাজুট হতে সুরধুনী ধারার মতই আকাশ ফেটে আপনার থেকেই ঝরে পড়ে কিনা কে জানে!
পকেটে টাকা থাকইে টাকার ধান্দায় বেরোও না কেন দাদা? বিনি বলত আমায়, তাহলে আর এই অসুবিধায় পড়তে হয় না। এই দুর্ভোগ ভুগতে হত না তোমাকে।