আমার কথায় তক্ষুনি তিনি কমলকে নিজের সহকারী করে নিলেন–একশ টাকার মাস মাইনেয়। সেই কিশোর বয়সেই নিজের নৈপুণ্যে কমল চিত্রকর্মের বিভিন্ন বিভাগে এমন দক্ষতা অর্জন করেছিল যে, তারপরে শৈলজার থেকে স্বতন্ত্র হয়েও সে কয়েকটি ছবি তুলেছিল নিজের পরিচালনায়। তার একটির সঙ্গে আমি একটু বিজড়িত ছিলাম। তার রক্তের টান বইটির, তারই নির্দেশ মতন, সংলাপংশটা লিখে দিয়েছিলাম আমি।
বইটার থেকে মোটামুটি বেশ মুনাফা হয়েছিল আমার। আপনজন বলে অযথা সুবিধা নেয়ার চেষ্টা না করে বেশ টাকাই দিয়েছিল আমাকে। তারপর ওটা বই হয়ে বেরুলেও ফের আমার অর্থাগম হয়েছে।
বইটার প্রথম সংস্করণ সে-ই নিজের খরচে ছাপায়, সঙ্গতভাবেই নিজের নামে, যদিও সংলাপাংশ যে আমার সে উল্লেখও ছিল তার ভূমিকায়। কিন্তু বইটা তেমন বেচতে পারেনি, বই কোথায় কীভাবে বিক্রি হয় তার কোনো ধারণাই ছিল না বেচারার। নিজের ছবির প্রদর্শনকালে সিনেমা হলেই বইটা চালাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার ধারণা, বইয়ের দোকানে সিনেমা দেখানোর মত, সিনেমা হলে বই চালু করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই সফল হবার নয়।
কষ্টেসৃষ্টে দু একশ কাটানোর পর সংস্করণটার বাকি কপিগুলি সে দিয়ে দিল আমাকেই অমনিই। দিয়ে যেন হাঁক ছেড়ে বাঁচল। আমি করলাম কি-টাইটেল পেজে লেখকের স্থলে তার বদলে আমার নামটা বসিয়ে পাতাটা নতুন করে ছাপিয়ে নিলাম আর ভূমিকার উল্লেখ থাকল- মূল কাহিনীটি কমলের। সংলাপ রচনাটুকুই শুধু আমার আর তাও যে তারই নির্দেশ মতই–তাও জানিয়ে একটু বেশি কমিশন দিয়ে ঐ বই-ই ছেড়ে দিলাম বাজারে।
দেখতে দেখতে কেটে গেল পুরো এডিশন। তার পরেও তার কিশোর, বয়স্ক বিভিন্ন সংস্করণে নানা নামে নামান্তরে বইটার কাটতি হয়ে রীতিমতই মোটা উপায় হয়েছিল আমার।
অথচ, ঐ বই সম্পর্কে আগ্রহ ছিল না আদপেই। পরের নির্দেশ মত সংলাপ রচনায় উৎসাহ পাইনি বলতে কি! ঠিক অর্থ লালসাতেই ঐ কর্ম ছিল না আমার, কমলের প্রতি প্রাণের টানেই করেছিলাম, তাহলেও বলতে হয়, রক্তের টানের সুবাদে তখনকার মতন অর্থের টানাটানি থেকে বেঁচে গিয়েছি।
কিন্তু রক্তের টান থেকে মোটামুটি আমার লাভ হলেও কমলের মোটমাট লোকসানই দাঁড়াল। কেবল প্রকাশিত ঐ বইটার থেকেই নয়, প্রদর্শিত ছবিটার থেকেও সিনেমা। লাইনের ঘাঁৎঘোঁৎ আর কারবারীদের আচার-আচরণ ভালো মত জানা ছিল না বলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে ছবির প্রদর্শনীর থেকে নিজের প্রাপ্য রয়ালটি আদায় করতে পারো, প্রায় সকলেই ওকে ঠকিয়েছে, অনভিজ্ঞ আর ভালো মানুষ হলে যা হয়। তাছাড়া নেহত ছেলেমানুষও ছিল তো! তারপরে বাংলাদেশে (তখনকার পাকিস্তানে) তার ছবিটা খুব চললেও আর জনপ্রিয় হলেও মোটা লাভটাই তাকে গচ্ছা দিতে হয়েছিল নাকি, কি কারণে জানি না, এক পয়সাও তার উদ্ধার করা যায়নি।
কমলের বেলাও দেখেছি, আর শৈলজা, গৌরাঙ্গ, প্রেমেনের বেলাতেও দেখলাম (এমনকি, উদয়ের পথে-র বিখ্যাত ধুরন্ধর লেখক জ্যোতির্ময় রায়ের বেলাও তার কোনো অন্যথা হয়নি) ফিৰ্ম-কর্মে গোড়ার দিকে দুপয়সা হলেও মূলে হা-ভাত হয়ে সব উপায়ই কেমন করে যেন উপে যায় হঠাৎ।, লাখ লাখ টাকা আমদানির পরেও লোকসানই দাঁড়ায় শেষপর্যন্ত। লাভের কড়ির কিছুই আর হাতে না থাকলেও প্রায় হাতকড়ির মতই অবস্থা হয় হয়ত বা। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এর থেকে ফয়দা তুলতে পারলেও অব্যবসায়ী স্বপ্ন-দেখা লেখক ও শিল্পীদের ভাগ্যে পরধর্মের মতই ভয়াবহ হয়ে ওঠে অচিরেই।
এবং তারপরে এই চোট সামলে উঠতে তাদের সময় লাগে বেশ। বিপথে গিয়ে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খাবার পর খাড়া হয়ে পা-র তলায় নিজের ঠাই-আগেকার ঠাইটি খুঁজে আর পায় না বোধহয়। যথাযথ ভাবে দাঁড়িয়ে যথোচিত ভাবে নিজের মাথা তুলে দাঁড়ানো বুঝি যায় না আর। কোথায় যেন কী হয়ে যায়!
অনেকটা যেন ডুব সাঁতারে অনেকখানি পেরিয়ে আসার মতই। ডুবে ডুবে অনেককাল। কাটিয়ে মাথা তুলে হঠাৎ দেখা যায়, কোথায় এলাম রে! এর মধ্যে বিস্তর সময়ের জলাঞ্জলি হয়েছে–কোথায় যেন যাবার ছিল, কোনখানে যেতে এ কোথায় এসে গেলাম! দেখতে পাই, ঠিক পথের থেকে বহুৎ পিছিয়ে পড়েছি। যারা ছিল অনুগামী, অনেক আগেই তাদের অনেকে উতরে গিয়েছে কখন!
অনন্য প্রতিভাধর কেউ কেউ হয়ত এমন ফাড়াকাটিয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু সবার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। অসামান্য শক্তিমান হয়েও আমাদের জ্যোতির্ময় রায় তা পারেননি, এই পথে পা বাড়িয়ে বিপাকে জড়িয়ে বিনত হয়ে নিতান্ত হতাশায় কেবল স্বক্ষেত্র থেকেই নয়, অকালে আকস্মিকভাবে ইহলোক হতেও বিগত হয়েছিলেন–এটা একটা ট্রাজেডিই। কেবল তাঁর নিজের দিক থেকেই নয়, বাংলা সাহিত্যেরও বলতে হয়।
আমাদের কালের এবং কল্লোলের বন্ধুদের মধ্যে কেবল নারাণ গাঙ্গুলিইখানিকটা গিয়েও ফিরে আসেত পেরেছিলেন যথাসময়ে। ফিলম জগতের সঙ্গে অংশত জড়িত হয়েও বিশেষ বিপর্যয়ে পড়তে হয়নি তাঁকে। চিত্রনাট্য আর সংলাপ-অংশ লিখেই তিনি নিরস্ত হয়েছেন, ফিলমি লাইনের হলেও যেটা হয়ত খানিকটা তাঁর নিজের লাইনেও বলা যায়, একেবারে স্বধর্মবিচ্যুতি নয় বোধ হয়, কিন্তু আরো এগিয়ে এই অক্টোপাশের ফাঁদে পা দিয়ে চিত্র পরিচালনা বা প্রযোজনায় দায় ঘাড়ে নিয়ে ল্যাজে-গোবরে ওতপ্রোত হয় যায়-যায় দশায় গিয়ে তাঁকে দাঁড়াতে হয়নি কখনই। তাই শেষ অব্দি তাঁর সাহিত্যের নবনবোন্মেষ আমরা লক্ষ্য করেছি-সুনন্দর জার্নাল পর্যন্ত। কোনোখানে কিছু বাধা পায়নি কখনো। এবং বেঁচে গেছেন অচিন্ত্য আর বুদ্ধদেব–ঐ মোহিনী মায়ার বাহুপাশ থেকে।