কবিরাজখানার উলটো দিকের বাড়িতে ছিল রমেশবাবুর পারিবারিক আস্তানা, আর রাস্তার এক কিনারে ছিল ছ্যাকরা গাড়িদের আস্তাবল। সেখানকার ঘোড়াদের গোবরের গন্ধামোদিত বৈঠকে বসে কবিরাজী মোদকের সঙ্গে লেখকরা সাহিত্যরসে আমোদিত হতেন। একরকম অশ্বগন্ধা রসায়নের মতই সঞ্জীবনী বলা যায়।
রমেশবাবু যেমন ভালো কবিরাজ ছিলেন তেমনি ছিলেন ভালো লেখক। কুরপালা ইত্যাদি কয়েকখানা উপন্যাস আর চমৎকার কতকগুলি ছোট গল্প লিখে গেছেন–কিন্তু বই আকারে সেগুলি এখন আর পাওয়া যায় না বোধহয়। সাহিত্যসংসদ বা বসুমতী সাহিত্যমন্দিরের মতন কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর রচনাগুলি একত্রে গ্রন্থাবলী আকারে বার করলে ভালো হয়। তাঁর সাহিত্য স্থায়িত্বলাভের অপেক্ষা রাখে।
সাহিত্য ক্ষেত্রের নবাগত অনেক লেখককে তাঁর সমিতির সহায়তায় প্রতিষ্ঠালাভে সাহায্য করলেও তিনি নিজে কখনো সামনে এগিয়ে এসে নিজেকে জাহির করতে চাইতেন না। খ্যাতির মোহ কোনদিন তাঁর দেখিনি। সাহিত্যিকসুলভ কোনও অহংকারও ছিল না তাঁর। তাই তাঁর মোহনায় নদ-নদীরা সহজ স্বচ্ছন্দে এসে মিশতে পারতেন।
সেকালে আরো দুটি নামজাদা সাহিত্যিক আসর ছিল-কল্লোল আর শনিবারের চিঠির। ঐ দুই মুখপত্রকে কেন্দ্র করে দুটি সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। সাহিত্যসেবক সমিতির কোনো মুখপত্র ছিল না, ছিলেন মাত্র এক মুখপাত্র-ঐ রমেশবাবুই। মুখ্যত তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণেই গোষ্ঠী নির্বিভেদে তাবৎ লেখকই তাঁর ঐ কৃষ্টিক্ষেত্রে এসে জমতেন।
প্রেমেনের প্রথম দর্শন পাই এক সিনেমা হলে (তার একটি রচনায় সেই বিবরণী রয়েছে), অচিন্ত্যর সঙ্গে আলাপ জমে ফুটবলের মাঠে, আর কবি নজরুলের সঙ্গে বহরমপুর জেলেই আমার জমজমাট, কিন্তু বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, সতীকান্ত গুহ প্রভৃতির সঙ্গে মোলাকাত আমার ঐখানেই। দরাজ ঐ কবিরাজখানার সঙ্গমস্থলেই বিভিন্ন দলের সাহিত্যিকরা এসে মিলিত হয়েছেন। পবিত্র গাঙ্গুলিও আসতেন ওখানে। শৈলজানন্দ, অচিন্ত্য, এমনকি প্রেমেনেরও কখনো কখনো পাত্তা পেয়েছি আমি সেখানেই এবং আরো কতোজনার!
আমার যাতায়াতের পথেই ঐ জংশনটা-না জমলেও সেটাই ছিল আমার হল্টিং স্টেশন। কদাচ বা ওয়েটিং রুম।
ঐ বাড়ির দোতলাতেই থাকত আমার বিখ্যাত বোন বিনিরা আর তার কাজিন কমল। ওদের জন্যে আমি অপেক্ষা করতুম সেখানে। কমলরা স্কুল থেকে ফিরলেই কেটে পড়তাম সেখান থেকে, বেড়াতে বেরুতাম তাদের নিয়ে, কিংবা পাশেই তাদের সদর দরজার চৌকাঠে বসে আগডুম বাগড়ম আলাপ চালাতাম আমাদের। পাশের সাহিত্য আলোচনায় জলাঞ্জলি দিয়ে।
সাহিত্যিক বা সাহিত্য আসরের আকর্ষণ চিরদিনই আমার কম। সাহিত্য বা সাহিত্যিক আমার কাছে কখনই আলোচ্য বস্তু নয়, তাদের আলোচনায় গেলে, বীরবলী ভাষায়–আলোর চেয়ে চোনাই বেরয় বেশি। আমার ধারণায় সাহিত্য হচ্ছে, সৌন্দর্যের মতই উপভোগের বস্তু-আস্বাদের জিনিস। এবং সে কাজ একান্তেই হতে পারে–একান্তভাবে করতে হয় যদি।
তাহলেও ঐ সমিতিটি সেই কালে আমার খুব কাজে লেগেছিল। আমার কাছে সাহিত্য আলোচনার জন্য উৎসুক কেউ এলে, হবু সাহিত্যিকরাই বেশির ভাগ, আমি তাঁদের রমেশবাবুর ঐ আড়তে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতাম। রমেশবাবু সানন্দে নিজের সমিতির সভ্য হিসেবে তাদের লুফে নিতেন। আর তারাও মাসিক চার আনা মাত্র চাঁদার বিনিময়ে ঢালাও আড্ডা আর আলোচনার সুযোগ পেত–সেই সঙ্গে চা কচুরি সিঙ্গারা তো মিলতই। সেদিক দিয়ে ওটা ছিল আমার ডাপিং গ্রাউন্ড।
রমেশবাবুর মত তাঁর ওষুধেরও আমি গুণগ্রাহী ছিলাম। আমার মতই ছিলেন হয়ত আরো অনেকে, কেননা তাঁর বহুমূল্য দাবাই তিনি বিনামূল্যে লেখক-বন্ধুদের দিতে সর্বদাই মুক্তহস্ত। তাঁর ওষুধ খেয়ে কতোবার যে বেঁচে গেছি বলা যায় না। একবার এমন মারাত্মক রক্তামাশায় ধরেছিল যে, সারছিল না কিছুতেই। আঁর চিকিৎসাতেই রক্ষা পাই। তিনি কী বটিকা আর পাঁচনের ব্যবস্থা করেছিলেন, আর আমার মামাতো ভাই কমল করেছিল বাঁচনের ব্যবস্থাটা। বিনির সাহায্যে বাড়িতে পাঁচন বানিয়ে (কত সের জলে ঐ পাঁচদি দিয়ে কিরকম জ্বালের আঁচে কতক্ষণ ধরে ফুটিয়ে জলটা মেরে কতটা থাকতে তা নামাতে হয় যেন-সে এক দারুণ দুষ্কর মহামারি ব্যাপার!) তার সাথে গাঁদাল পাতার ঝোল আর ভাত নিয়ে তার স্কুলের টিফিনের সময় রোজ এসে খাইয়ে যেত আমাকে–মাসখানেক ধরে প্রায়। কিন্তু চিকিৎসাটা অব্যর্থ বলতে হবে, কেননা তার পরে আমার জীবনে ঐ ব্যারাম আর ধরেনি আমায়।
ফোটোগ্রাফিতে আশ্চর্য নৈপুণ্য ছিল কমলের-ঐটুকুন বয়সেই। সেই কালেই সে কোডাকের বাক্স ক্যামেরায় জে, এল, বাঁড়ুজ্যের (কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে কাছাকাছি বাড়িতে তিনি থাকতেন তখন ) এমন চমৎকার এক ছবি তুলেছিল যে, বাঁড়ুজ্যেমশাই, তাঁর অসংখ্য ফোটোর ভেতর সেটিকেই সবচেয়ে পছন্দ করতেন। তাঁর টেবিলের ওপর সুদৃশ্য ফ্রেমে সাজানো থাকত ফোটোটা। তাঁর বিখ্যাত নোটবইগুলির প্রকাশক সেনরায় কোম্পানির একেবারের ক্যালেন্ডারে কমলের তোলা জিতেনবাবুর সেই ছবিটিই ছাপা হবার মর্যাদা লাভ করেছিল।
শৈলজানন্দ তখন সাহিত্য বাদে চিত্রজগতে বাদশাহীত্ব করছিলেন। সব্যসাচীর মতন তিনি তখন নিজের কয়েকটি অপরূপ উপন্যাসের পরমাশ্চর্য চিত্ররূপ দিয়েছিলেন–প্রায় সবগুলিই তার হিট ছবি হয়েছিল। পরিচালকরূপে তাঁর খুব নামডাক তখন। তাঁর কাছেই নিয়ে গেলাম কমলকে।