কিন্তু বৌ মরলেই তো ফুরিয়ে গেল ভাই। আমার আশঙ্কা জানাই।–তখন?
বৌ কি ফুরোয় কখনো? মরলেই কি ফুরিয়ে যায় সব? বৌরা অফুরন্ত। সে সব দিক ভেবেই আমি দু-দুটো বিয়ে করে রেখেছি। একবার এটার, একবার ওটার দায়ধাক্কা সামলাই…।
আর ধারাবাহিক তোমার যততা বায়নাক্কা সেই সঙ্গে! আমি কই, কিন্তু বার বার তোমার পালে বাঘ পড়লে কথামালার সেই রাখালের দশা–সেই দুর্দশা না দাঁড়ায় আবার! তার না হয় গরুর পাল ছিল, কিন্তু তোমার তো আর জরুর পাল নেই। দুটি মাত্র সম্বল। দুটো গেলেই খতম! তোমার নটের গাছটিও মুড়োলো-সব গল্পই ফুরোলো।
না, তা হয় না। তা হবার নয়। বিবাহিত লোকদের প্রতি বিবাহিত ব্যক্তির সহানুভূতি থাকেই, অনিবার্যই থাকে, না থেকে যায় না। বৌকে নিয়ে ভুগতে হয় সবাইকে, সবার বৌয়েরই অসুখ-বিসুখ লেগে রয়েছে–তাই নিয়ে ভোগান্তি সবাইকার। সকলেই হমুদ ভুক্তভোগী। তাই শুধু সহানুভূতি হয় কেমন একটা ফেলোফিলিং রয়ে গেছে তাদের ভেতর। ফন্তু স্রোতের মত অন্তরে অন্তরে ওতপ্রোত-সক্কলের। পরের দুঃখে কাতর হয়ে নয়, নিজের দুঃখের কাতরতা অনুভব করেই পরস্পরকে তারা সাহায্য করে। নিজের বৌয়ের কথা ভেবেই আমার বৌয়ের দুঃখটা তাঁরা ফীল করতে পারেন।
আর তোমায় ফুলফিল করেন?
এটাও এক রকমের স্ত্রৈণতা বলেই আমার বোধ হয়। হয়ত বা পরস্ত্রীকাতরতাও বলা যায়। তবে সদ্ভাবের সাত্ত্বিকতায় এখানে ব্যক্ত, হয়ত এর আবার রাজসিক তামসিক দিকও থাকতে পারে-সেটা তামাশার কিছু না। তবে তা নিয়ে কিছু বলছি না…!
তুমি স্ত্রীভাগ্যে ধনী হে নৃপেন। তুমি ভাগ্যবান!
বলতে গিয়েই আমার খটকা লাগে। খট করে লাগে যেন কোথায়। গ্রীনরুমের নেপথ্যে বলা শরৎচন্দ্রের সেই কথাটা মনে পড়ে যায়…শিবরামের ফের টাকার দরকারটা কিসের? ছেলেপুলে নেই, বৌ নেই, সংসার নেই-টাকার আবার কী দরকার তার!
সেই অফেলো-ফিলিংসুলভ তাঁর কথাটার মূল তত্ত্ব তাহলে এখানেই। অবিবাহিতরা দুনিয়ার সবার বিলকুল সহানুভূতি-বর্জিত।
স্ত্রীভাগ্যে ধন! বলেই দিয়েছে–তুমি জানতে না? নৃপেন আমাকে প্রায়।
শোনা ছিল বটে কথাটা, কিন্তু তার মানে যে এই তা আমার জানা ছিল না ঠিক। আমি স্ত্রীভাগ্য বলতে ভেবেছি অন্যরকম…মানে, কুমারী অবস্থায় মেয়েরা তো নেহাত গরীব থাকে। একটা পয়সাও পায় না কখনো কোথাও। ছেলেরাই মার সবটা আদর পায়, কেড়ে-কুড়ে খায়, জোর করে আদায় করে সব কিছু-টাকাপয়সার দরকার পড়লে ইচ্ছেমতন বাপ-কাকার পকেট মারে। মেয়েরা তো তা পারে না। পারতেও চায় না। তারা গোধূলি লগ্নের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে। সেই ছাঁদনাতলায় গিয়ে ওতরালে, কোনোরকমে কারো কণ্ঠলগ্ন হতে পারলে একবার-কে পায় তাকে আর? চিরদিনের মতই তার দুঃখ-নিশি পোহায়। স্ত্রী হলেই সে ধনী হয়ে যায়-তার ভাগ্য ফিরে যায় এক নিমেষে-বরাত খুলে যায় হঠাৎ! হস্তগত বরের রোজগারের সব টাকাটা মাসকাবারে তার আঁচলের খুঁটে এসে রাঁধা পড়ে, অন্য খুঁটে বাঁধা থাকেন স্বামীরত্নটি! খুঁটোর জোরে গরু লাফায়, আর ওই খুঁটোর জোরে জরুরা। তাদের মতন ধনী আর কে তখন! স্ত্রীভাগ্যে ধন, তার মানে আমি এই ভেবেছিলাম-স্ত্রীর ভাগ্যেই। ভাগ্যে কারো স্ত্রী হতে পারলেই ধনী তখন।।
এই কারণেই মেয়েরা বুঝি ধনি-রূপে সমোধিত হয়ে থাকে। পদাবলীর কথাটাও আমার মনে পড়ে…য গোধূলি লগন বেলি/ধনি মন্দির বার ভেলিনিবজলধরে বিজুরি চমক/দ্বন্দ্ব পসারি গেলি আমার মনে প্রতিধ্বনিত হয়।
তোমার কথা যেমন উল্টোপাল্টা, তোমার মাথাও তেমনি উল্টোরকম… বলে সে হাসতে থাকে–যাক গো, এবার তাহলে তোমার নিজের ভাগ্যও ফিরিয়ে নাও না! মাথা খাটিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগিয়ে দাও।
কী করে লাগাবো? বৌ কোথায় আমার? বিয়েই করিনি যে
বিয়েই করোনি! একটাও না? তাহলে আর কী হবে!
আমার স্ত্রীবিয়োগে সে যেন ব্যথিতই বোধ হলো।
কিছুই হবে না। আমার ভাগ্যে অর্থযোগ নেই, জানি আমি। আমার জীবন নিরর্থক। কী করবো?
কী করবে! একটা বিয়ে করে ফ্যালো। আবার কী?- সত্যি সত্যি না হলেও, মিথ্যে মিথ্যে, নইলে তোমার বরাত খুলবে না। দশ পাঁচ টাকার এই উঞ্ছবৃত্তি করেই কাটাতে হবে সারাজীবন।
এখন আমার মনে হয়, নৃপেনের কথাই ঠিক। স্বভাবতই সপত্নীকদের প্রতি দরদ সবার। আমি যদি পত্নীবান হতাম তাহলে সুভাষচন্দ্র কি হেমেন্দ্রপ্রসাদ অমন করে এক কথায় বা বিনা বাক্যব্যয়ে আমায় বিদায় দিতে পারতেন কি কখনো? আমার প্রতি মমতা না থাকলেও অন্তত এই টাকাটা গেলে আমার বৌ-ছেলের কী হবে, তা ভেবেও ওঁরা একটু ইতস্তত করতেন বইকি।
নৃপেনের যেকালে নিজের বৌ ভাঙিয়ে ষোলো আনার ওপর আঠারো আনার প্রাপ্তিযোগ, সেখানে আমার এই ব্যাঙের আধুলি কোনো ব্যাংকেই ভাঙানো যাচ্ছে না, সর্বত্রই আমার জন্য অর্ধচন্দ্র!
.
৭৯.
চোরবাগানের চৌহদ্দিতে মুক্তায়াম বাবু স্ট্রীটের মোড়টাইে ছিল রমেশবাবুর (কবিরাজ রমেশচন্দ্র সেন) কবিরাজখানা। সেখানেই ছিল তাঁর স্থাপিত একদাবিখ্যাত সাহিত্যসেবক সমিতি। সাহিত্যছত্রের পদাতিক কবি থেকে রাজতুল্য লেখকরাও এসে জমতেন–তাঁর সেই কবিরাজী আড্ডায়। নিয়মিত ভাবেই ঐ সমিতির বৈঠক বসত; সাহিত্যিকদের ওঠা-বসা যাওয়া-আসা গল্পগুজব চলত প্রায় সব সময়। আমিও মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে ওঁদের সাহিত্যভোজে খাদ্যাখাদ্যের অংশ নিয়েছি-সাহিত্যের সেই কবিরাজী কাটলেট-উইথ এ পিষ্ট অব ভাস্কর লবণ।