কোনো ভয় নেই, তেমন শ্রুতিধর স্মৃতির বালক বাংলাদেশে জন্মায়নি এখনো। পড়া শোনায় সমান টান এমন কেউ অতি বিরল। পড়ার পরে মনে থাকে, শুনলেও মনে রাখে এমন কাউকে আমি তো ভাই দেখিনে আজকাল।
তা হলেও তোমাকে বলা আমার কর্তব্য, জানিয়ে দিচ্ছি তাই, ধরা পড়লে কিন্তু তোমাকে আর কোনো প্রোগ্রাম দেওয়া যাবে না। বেতারের কাক লিস্টে নাম উঠে যাবে তোমার, মনে রেখো।
ওঠে উঠুক, প্রোগ্রাম না পাই তো কী আর করব? কিন্তু এটা তোমার রেডিয়োওলাদের ঠিক নয় ভাই। না না, আমি প্রোগ্রাম দেওয়া না দেওয়ার কথা বলছি না, আমি বলছিলাম, ওই ত্রিশ টাকা মাত্র দিয়ে বস্তুত লেখাটার সর্বস্বত্ব দখল করে রাখার কথাটাই। একটা লেখার সঙ্গে কত রকমের রাইট জড়ানো থাকে জানো? তার অনুবাদ স্বত্ব, গ্রামোফোন স্বত্ব, ড্রামাটিক স্বত্ব, প্লে-রাইট, ফ্লিম-রাইট, কখনো যদি এদেশ টেলিভিসন হয় তা হলে সেই টেলিরাইটও। কেবল রেডিওরাইটের নামমাত্র দক্ষিণা দিয়ে ওই সব অন্য রাইটগুলো ব্যবহার না করলেও ঐভাবে আটকে রাখাটা ঠিক কি?
ঠিকঠাক করার মালিক আমি নই। আমার তোমাকে বলা-কর্তব্য তাই বললাম, তোমার যা দরকার করবে। যাক্ গে, সুধীরবাবুর দোকানে আর কে কে আছেন এখন? কাকে কাকে দেখলে ওখানে?
খেয়াল করে দেখিনি। তবে সুধীরবাবু রয়েছেন। বসিওনি, আড়াও দিইনি, এক মিনিটের কাজ আমার। গেলাম, লেখাটা দিলাম, তারপরে শ্বেতপত্রের প্যাডটা খুঁজে বার করলাম, গল্পের নাম, দক্ষিণার পরিমাণ যথাস্থানে বসিয়ে সই করে তাঁকে দিতেই তিনি ড্রয়ার থেকে টাকাটা বার করে দিলেন। আমারও পত্রপাঠ বিদায়।…অবাক হচ্ছ কি? আমার ভাউচার লেখার কষ্টটুকুও তাঁকে আমি করতে দিইনি। অনেক কষ্টে টাকা পেতে হয় ভাই, তাই এ কষ্টটুকুও আমিই স্বীকার করি।
বেশ করো। আমার করিৎকর্মের কুশলতায় তাকে একটু খুশি মনে হয়।
তুমি যাচ্ছো নাকি মৌচাকে? যাও না, সুধীরবাবু এখন কোনেই তো। একটুখানি বসলে পরে আরো অনেককে পাবে ওখানেই। অচিন্ত্য প্রেমেন প্রবোধ…ওরাও আসতে পারে।
নৃপেনের তেমন উৎসাহ দেখা গেল না–এখন গেলে আমার হবে না, টাকার দরকার আমার। অন্য কারো সামনে সেটা হবার নয়।
তবে এখনই যাও না! তেমন কেউ আসেনি এখন…।
আমার তো তোমার ওই পাঁচ-দশ টাকার গরজ নয় ভাই। আমার চাহিদা অনেক, আমার খিদে ওতে মিটবে না। আরো চাই আমার।
চাইলেই পাবে-যাও না। আমার মতন এখনই লেখা দিয়ে নিতে হবে যে তাও না, সুধীরবাবু তোমাকে স্নেহই করেন। পরে লিখে দেব বললেও হবে।
না, যাব আমি। তবে এখন নয়। ওঁর বাড়িতে যেতে হবে আমাকে। রাত্তিরে। রাত বারোটার পরে।
বারোটা বাজাতে যাবার কী প্রয়োজন? আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
আমার বৌয়ের শক্ত অসুখ যে! এখন-তখন অবস্থা। হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে না? কেবিনে নিতে হতে পারে।
ওমা, তাই নাকি! তা হলে খুব জরুরি দরকার বলতে হয়–জরু-র দরকার যেকালে। এখনি তুমি যাও তবে, ওঁকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বলবে এখন।… আহা, সেই জন্যেই তোমার এই চেহারা, উসকোখুসকো চুল, চান কররানি, তেল দাওনি মাথায়, এমনতরো মুখচোখ! আগে আমি বুঝতে পারিনি ভাই।
না, এখন গেলে হবে না। যথাসময়ে যেতে হয়। বিপদের কি সময় অসময় আছে? বিপন্ন মানুষের অযথা সময়ই হচ্ছে যথাসময়। সুধীরবাবুর কাছে যেতে হবে আমাকে ওই বারোটার পরেই…।
তখন তো খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছেন উনি।
সেইটেই হবে ঠিক সময়। বিপদগ্রস্ত লোকের কি মাথার ঠিক থাকে নাকি? আমার মাথা ঠিক থাকলেও, চুলের ঠিকঠাক থাকবে না–আরো উসকোখুসকো করতে হবে এগুলোকে। তারপর বেছে বেছে ওই সময়ে, বারোটায় কি তারও পরে গিয়ে হানা দেব তাঁর বাড়ি…ঘুম থেকে উঠে ঢুলতে ঢুলতে নিচে নেমে এলেই বেশি আমায় বলতে হবে না আর, আপনার থেকেই আমার বিপদটা হৃদয়ঙ্গম হবে। ওই আআর্থলি টাইমটাই আমার বিপন্নতার সাক্ষ্য দেবে-বেশি চিন্তা বিবেচনার সময় তিনি পাবেন না, সেফ খুলে হাতের কাছে যা পান, দুশো পাঁচশো, দিয়ে দেবেন তৎক্ষণাৎ।
তৎক্ষণাৎ?
নিশ্চয়। অমনি করে অমন সময়ে গিয়েই চাইতে হয়। তা হলেই হয়ে যায়। খুব সহজেই হয়। আর কিছু না হোক, অসময়ের এই আপদ বিদেয় করার জন্যেও, নিজের ঘুমের গরজেই, বিনাবাক্যব্যয়ে টাকাটা দিয়েই বিছানায় গিয়ে তিনি কাত হতে চাইবেন তক্ষুনি। একটু থেমে সে বলে, মোটামুটি পেতে হলে এমনি অসময় বেছে বেছে যেতে হয়।
তাই নাকি? তা তুমি এভাবে আরো নিয়েছে নাকি ওঁর কাছে?
কতোবার! আর খালি ওঁর কাছেই কি! আরো কি আমার প্রকাশক নেই নাকি? সবাইকে এইভাবেই বন্ধ করতে হয়!
লেখক আর প্রকাশকের সম্পর্কটা খাদ্য-খাদকের, এমনধারা একটা কথা কোথায় যেন শুনেছিলাম! পরস্পরকে খেয়ে ওরা বেঁচে থাকে। কথাটা মিথ্যে নয় দেখছি। প্রকাশকরা যেকালে লেখককে তিলে তিলে মারেন, প্রকাশককে মারতে হলে লেখককে যেখানে তালে তালে থাকতে হয়। যেমন নৃপেনের এই তালটা।
তোমার বৌয়ের কোনো অসুখবিসুখ হয়নি তা হলে? বাঁচলাম। আমি হাঁফ ছাড়ি।
হয়নি, তবে হবে। হতেই থাকবে। হাসপাতালে তো ভর্তি করি এখন। ফ্রি বেড পাব না, জানা কথাই। কেবিন নিতে হবে। কেবিনের খরচা বহুৎ। ওষুধপত্র কেনার, নার্স রাখার অনেক দায়। সে সব দায় আমার সামলাবে কে? ওই সুধীরবাবুরাই। তারপর তার অপারেশন রয়েছে। কতো কী আরো। তারপর সে মারাই যাবে হয়তো বা–তার খরচা নেইকো? কদ্দিন আর ধরেবেঁধে তাকে বাঁচানো যাবে? বার কয়েক হাসপাতাল কেবিন করার পর বাধ্য হয়েই তাকে মারতে হবে আমাকে। তখন ঘাটখরচা, গটগচ্ছা আরো আরো। আমার কী! ওই প্রকাশকের, মানে, সুধীরবাবু প্রমুখদের। তবে ওই উনিই মুখ্য।