মানুষ পাগল হয়ে গেলে যেসব ছবি আঁকে অথবা যে সব ছবি আঁকবার পরেই পাগল হয়ে যায়। বনমানুষরা যে ধারায় সভ্যতার পাড়ায় এসে পৌঁছেছে-যার ধারণায় মহৎ লেখকরা মহত্তর শিল্পী বনে যান শেষে সেই সব হেস্তনেস্ত কাত! তারই হিস্ট্রি জিয়োগ্রাফি–তাবৎ হদিশ!
অবশ্যি, নির্দিষ্ট দিনক্ষণের আগেই আমার সেই চিত্ৰকাহিনী শেষ করতে পেরেছিলাম। আর, সেই বিচিত্রিত গল্পটার–সর্বত্যন্ত–ড্যাশ-উইদিন ইনভার্টেড কমার শিরোনামার ঠিক নীচের থেকে শুরু করে গল্পের অন্তিম পৃষ্ঠায় আমার নাম স্বাক্ষরের ওপর অবধি কেবল ওই সব ছবি ই পাগল-করা ছবি সব! পাতার দুধারেই-মার্জিনও বাদ নেই তারমার্জনা নেই কোনোখানেই।
অবশেষে যথাসময়ে নৃপেনের কাছে গিয়ে হাজির।
এনেছে গল্পটা? যাক্, বাঁচালে বাবা! যা ভাবনায় ফেলেছিলে না! দেখি, দাও। সে। হাত বাড়ায়।
গল্পটা হাতে নিয়ে সে চমকে উঠেছে তক্ষুনি–এ কী হে! এসব কী তোমার। এতসব আঁকিবুকি কিসের?
আমি কী জানি! কী যে এসব আমি কি নিজেই তার কিছু জানি নাকি! আমি জানাই, মনের উৎস থেকে উৎসারিত ভয়ঙ্কর মহামহিম কিছু হবে হয়ত.নতুন ধরনের কোনো অঙ্কনরীতির নয়া ধারার শিল্পশৈলী এই রকম কিছু একটা হবে বোধহয়…এখন কিচ্ছু টের পাওয়া যাচ্ছে না, পরে এককালে এই নিয়ে দারশ হইচই পড়তে পারে! পড়বে হয়তো, দেখো তুমি।
ধুত্তোর! গল্পটা কোথায়? তোমার গল্পটা কই হে?
কেন, ঐ যে পাতার মাথায়–তোমার দেওয়া শিরোনামার পাশটাতেই গল্পটা গোটা গোটা অক্ষরে উজ্জ্বল করে দাগা। দেখতে পাচ্ছ না?
তখন সে দেখতে পায়। দাগাও পায় বোধ হয়। সর্বমত্যতম-এর পাশে ড্যাশের ফাঁকা জায়গাটায় মোটা মোটা আখরে গাঢ় করে দেগে দেওয়া কথাটা…একমাত্র কথাই একটা কথাই- মাত্রা ছাড়িয়ে চোখের ওপর জ্বলজ্বল করছিল!
ধ্যাৎ! বেশি আর কিছু না বলে ঐ এক কথাতেই সে নিজের ধিক্কার জানায়।
হ্যাঁ, ঐ গর্হিতম! ওটাই–আমার গল্প। ঐ কথাটা দিয়েই তোমার দেওয়া নামটার আমি ফিল আপ দি গ্যা করে দিয়েছি। তোমার সর্বমত্যতম্-এর পরে আমার ঐ গহিতম! সত্যি ভাই, ভেবে দেখলে গহিত ছাড়া কী আর? ছোট দরের–ছোটদের লেখক-পাঁচ সাত টাকার গল্প লিখে খাই, প্রাংশুলভ্য ফললোভী বানরের ন্যায় তোমার ঐ ত্রিশ টাকার দক্ষিণার জন্য উদ্বাহু হওয়া আমার পক্ষে গহিত ছাড়া আর কী? তাই ওই কথাটাই ভালো করে খোদাই করে আমার এই দারুণ খোদকারি শেষ করেছি।
.
৭৮.
নৃপেন তার পরেও আবার প্রোগ্রাম দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু প্রথমটার মতন লেখার নাম আগের থেকে দেগে দেয়নি ফের অমন। নতুন করে দাগা আর দেয়নি সে আমায়। এর পরে তার চুক্তিপত্রগুলোয় এ হিউমারাস স্টোরি বলেই উল্লেখ থাকত মাত্র। আমারও লেখার কোনো অসুবিধা হত না।
একটা গল্প লিখে তার দুটো কপি করে (হারাবার ভয়ে নয়, আরো একটু বেশী জেতবার মতলবেই এক গল্পের দুটো কপি করা) একটা কপি মৌচাকে নগদ বেচে অন্য কপিটা বেতারে পড়ে দিয়ে চেক নিয়ে আসতাম।
আসতাম সেই মৌচাকেই আবার। কেননা, ক্রস চেক ভাঙাবার কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না আমার, কোনো কালেই নেই, সে কারণে আমার বরাতে কখনো ঐরূপ ঘটলে সুধীরবাবুর কাছেই আসতে হত আবার। তিনি অম্লানবদনে চেকটা ভাঙিয়ে দিতেন–শুধু চেকের পিঠে আমার সই করিয়ে নিয়েই তাঁর এই পৃষ্ঠপোষকতা!
আবার একদিন নৃপেনের সঙ্গে দেখা হল আমার–ওই পথেই। সেই রকম উসকোখুসকো চেহারা, ভাবগর্ভ মুখচোখ-উদাস উদাসীন! মৌচাকের থেকে আসছিলাম, থোকথাক ছিলও কিছু পকেটে, কিন্তু ওকে মুখোমুখি দেখেও আমার সন্ত্রস্ত হবার কিছু ছিল না। বরং ওর উপকারের ঋণ যৎসামান্য উদ্ধারলাভ হয়, কে তাতে পেছোয়?
কিন্তু সে, সুযোগ হয়নি আর আমার। নৃপেন তারপর কোনোদিনই আমার কাছে কিছু ধার চায়নি কখনো।
কোত্থেকে আসছ হে? সে শুধোলো।
কোত্থেকে আর? সেই মৌচাক।
মধু সংগ্রহ হল?
হল বইকি কিঞ্চিৎ।
গল্প বেচে? এ মাসে যেটা আমার আসরে পড়তে যাচ্ছে, সেইটেই বেচে দিয়ে এলে আগাম?
ধরছো ঠিক। সেই পাঠাই বটে-একবার মাথার দিকে কাটো আরেকবার লেজের দিকে। রেডিও পাঠ্যই হোক আর যাই হোক, কোনো বস্তুকে নানা অর্থে না পেলে আমার পাঠকৃষ্ণ মেটে না। পাঠওয়ালার প্রিভিলেজ।
ওটা কিন্তু নিয়ম নয়, তা জানো? চুক্তিপত্রের পেছন দিকটা পড়ে দেখেছো?
দেখেছি বই কি। সেই জন্যে গল্পটার নাম বদলে দিতে হয় আমায়। গোড়ার দিকটা পালটে দিই। কলেবরও বদলে দিতে হয় একআধটু। আর দেহান্তর ঘটলেই নামান্তরে কোনো দোষ হয় না। যেমন, যিনিই রাম তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই আবার শ্রীরামকৃষ্ণ–একই প্রভু ভিন্ন দেহে নামান্তরে–তাই না? আমারটাও প্রায় সে-রকম আর কি!
তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার কথায় তবুও ওর কিন্তু কিন্তু থাকে। কিন্তু আবার কী? অবতারভেদে যেমন একই ভগবত্তা, আমার বেলাও প্রায় তাই একই গল্প বিভিন্ন অবতারণায়। তা ছাড়া, মৌচাকে ছাপানোটাই তো আমি রেডিয়োয় পড়তে যাচ্ছিনা, আগে বেতারে পড়ছি, তার পরে মৌচাকে বেরুচ্ছে। এ মাসেই যে বেরুবে তার কোনো ঠিক নেই, কবে যে বার হবে কে জানে। সে সুধীরবাবুর মর্জি।
কিন্তু আমার আসরের ছেলেমেয়েরা যদি ধরতে পারে. আর তার পরে জানিয়ে দেয় রেডিয়ো আপিসে…ওপরওলাদের কাছে কমপ্লেন গেলে।