গার্সটিন প্লেসে ক্লাইভের আমলের পুরনো এক বাড়িতে বেতারের আসর বসত সেকালে। খুঁজেপেতে সেখনে গিয়ে হাজির হলাম একদিন।
যেতেই সে একটা চুক্তিপত্র আমার হাতে তুলে দিল। তার সেই আসরে কয়েক মিনিটের গল্পপাঠের আমন্ত্রণী।
এবং তার দক্ষিণা–ত্রিশ টাকা, গল্প পাঠ, নগদ। সেটাও সেই চুক্তির সঙ্গে উল্লিখিত। চুক্তিনামাটা দেখি, নানান নিয়মকানুনে বিড়ম্বিত, তার মুখ্য স্থলে আমার পাঠতব্য গল্পটার নামটাও নির্দেশ করা রয়েছে-সর্বমত্যন্ত অত্যন্ত-এর পরে মোক্ষ এক ড্যাশ!
গল্পটার নাম। তুমি যেটা পড়বে- তারই শিরোনাম লিখে দেওয়া হয়েছে। এই নামের সঙ্গে খাপ খায় এমন একটা গল্প তোমাকে লিখতে হবে এখন।
ও বাবা! শুনেই আমি চমকাই।
ঘাবড়াবার কী আছে? আমরা আগে গল্প লিখে তার পরে তার নাম লাগাই, এখানে আগেই নাম বসিয়ে তার পর গল্পটা বাগানোএই তোর লাগাম তো পেয়েই গেলে, এখন জুতসই একটা গল্পের ঘোড়া এনে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া কেবল। সেটাই তোমার দায়। এ আর তুমি পারবে না?
পারব কি না ভাবি। এতকাল গল্প লিখে তার পরে নামকরণ করেছি, এখন আগে নাম ফেদে পরে তার গল্পটা ফাঁদা, এ আবার কেমনতর ফাঁদ–কী ফ্যাসাদ…কে জানে! ঘোড়ার লাগামটা তো আগাম বাগালাম, এখন তার ল্যাজামুড়ো মেলাতে পারলে হয়! পারব কি না খোদাই জানেন।
কিন্তু এতগুলো টাকাও তো ফ্যালনা নয়! সই দিয়ে চুক্তি নিয়ে বাসায় ফিরলাম–শেষ পর্যন্ত শহীদ হবার জন্যই বুঝি বা!
নির্দিষ্ট তারিখে যথাসময়ে আসবে, তার কোনো অন্যথা না হয় যেন। বরং আধঘন্টাটাক আগেই এসো তুমি। গল্পটা পড়ে দেখব তো, তোমার একটু রিহার্সাল দেওয়ারও দরকার হতে পারে। বেশ করে মনে করিয়ে দেয় নৃপেন : বেতারে এর আগে পড়োনি তো কখনো।
বাসায় ফিরে ভাবতে বসলাম। কী লেখা যায়? ভাবনায় কাতর হয়ে কাত হলাম অবশেষে কিন্তু যে গল্পরা এতদিন অকাতরে এসে আমাকে দেখা দিয়েছে, তাদের কারো একটার টিকিরও নাগাল পাওয়া গেল না।
নামটা তো বেশ ফলাও করা। এখন কলাকৌশলে কোনোরকমে নামসই একটা গল্প ফলানো বইতো নয়। সর্বমত্যতম নামখানি তো হয়েই রয়েছে, এর সঙ্গে জুতমতো মজবুত মতো একটা কাহিনী আমদানি করা কেবল। খাপ পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে তলোয়ারের খাপ খাওয়ানোটা বাকী। একটা বেখাপ্পা ঠেকলেও এইটুকুই দায় আমার।
কিন্তু নিতান্ত সহজ দায় না। দায় সারা সহজ নয়। মগজ থেকে কিছুতেই কোনো গল্প আদায় করা যায় না! যতই কলা ফলাই, কৌশল খাটাই, আদায়-কাঁচকলায় হয়ে যায় শেষটায়।
লাগাম আগাম মিললেও ঘোড়া আমার কিছুতেই আগায় না। কিন্তু ঘোড়া না দেখে কেবল লাগাম দেখেই খোঁড়া হওয়া সাজে কি? তীরে এসে তরী ডুববে আমার? তীর্থে এসেও সৌভাগ্যলক্ষীর দর্শন পাব না!
ভাবনার কূল পাইনে সত্যিই! গল্প তো লিখেছি, কিন্তু এ ধরনের গল্প কখনো লিখিনি। ছোট্ট একটুখানি বীজের থেকে বড় বড় মহীরূহ গজিয়ে ওঠে, লোকে বলে থাকে, আমি নিজের চোখে কখনো দেখিনি বটে, তবে লোকের কথায় অবিশ্বাস করতে চাইনে। তবুও একথা আমি বলব যে গাছের বেলা হয়ত তা সত্যি হলেও, গল্পের বেলায় অ করতে যাওয়া দারুণ দুর্ধর্ষ ব্যাপার। নামমাত্র বীজের থেকে গোটা রামায়ণ বার করে আনা, বাল্মীকিসুলভ আর যার হোক, আমার না।
বলব কি মশাই, যই প্লট ফাঁদি আর গল্পই বাঁধি না, আর যত রকম করেই ছকতে যাই, ছা হয় না কিছুতেই! কোনো মতেই গভীর জলের থেকে মৃগেলকে টেনে তুলে নিজের পথে আনতে পারি না। কোন্ বনের হরিণের মত সে পালিয়ে বেড়ায়, আমার মায়াজালে সেই মায়ামৃগ ধরাই দিতে চায় না। মরীচিকা হয়ে থাকে, মৃগয়া হতে আসে না মোটেই।
ওই সর্বমত্যন্তম– এর সঙ্গে কিছুতেই কিছু খাপ খাওয়ানো যায় না। একটা গল্প লিখতে গিয়ে ভাবতে একশটা গল্প এসে যায়, এমন মুশকিল! মনের মধ্যে গল্পের একশা আর মনের মত আর প্রত্যেকটাই, কিন্তু নামের মতন একটাও না!
ভাবতে ভাবতে সাত রাত্তির ঘুম নেই, এমন কি দিনের বেলাও দুচোখ বুজতে পারি না। চোখের কোলে কালি পড়ল, মাথার চুল সাদা হতে শুরু করল। আদ্ধেক চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম, টাকার চিন্তায় এই করেই বুঝি টাক পড়ে সকলের? যাদৃশী ভাবনার্যস্য…এমনি করে পড়া টাকের পরেই অর্থসিদ্ধিটা আসে তারপর–ভাবনা মাফিক। যাই হোক, আমার বরাতে চুলও গেল কিন্তু চুলচেরা এত খতিয়েও সেই গল্প এল না-ত্রিশ টাকার মওকা তেমনি সুদুরপরাহত রয়ে গেল! কামড়ে কামড়ে ফাউন্টেন পেনের আধখানা ভুড়ির গর্ভে গেল আমার। কত গল্পই এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এল আর গেল কিন্তু কোনোটাই ওই নামের সঙ্গে খাটল না।
তখন আমি নিজেই খাটলাম–আমাকেই খাঁটিয়া নিতে হোলো শেষটায়।
শুয়ে শুয়ে আমার খাতার শুভ্র অঙ্ক কলঙ্কিত করতে লাগলাম। আমার অনাগত গল্পের আষ্টেপৃষ্টে ললাটে কতো কী যে আঁকলাম আমি! অঙ্কনের আলপনায় গল্পের কল্পনারা ধরা দিতে লাগল। রেখায় রেখায় দেখা দিল–কখনো একক, কখনো বা জোড়ায় জোড়ায়। কী না আঁকলাম খোস মেজাজে–কাকের সঙ্গে বক জুড়ে, বাঘের সঙ্গে কুমীরের কোলাকুলি বাধিয়ে, হনুমানের সঙ্গে জাম্বুবানকে জর্জরিত করে, বকের সঙ্গে কচ্ছপের মচ্ছবে সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার! বিতিকিচ্ছিরি!
সব জড়িয়ে ইলাহী কান্ড এক! কী যে ওই সব ছবি–তার কিছু বুঝবার যো নেই, অথচ বুঝতে গেলে অনেক কিছুই বোঝা যায়। গুহামানবরা একদা যেসব ছবি আঁকতো, এবং মানুষের মনের গুহায় মনশ্চক্ষুর অগোচরে, অন্তরের অন্তরালে তার অবচেতনায় এখনো যেসব ছবি অনুক্ষণ অঙ্কিত হচ্ছে, মনের সেই সব আঁকুপাঁকুনিদারুণ এক গুহ্য ব্যাপার। মনের গর্ভপাত সেই সব দৃশ্য আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেও এসে হানা দিতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে–আরেক উৎপাত!