এই বোধধাদয়ের পরই তো উপক্রমণিকা, আরেক জীবনের ভূমিকা। এই জন্মেই পুনর্জন্মের দ্বিজত্বলাভ। নতুন করে হওয়া আবার নয়া ব্যাকরণে–সংস্কৃত জীবনায়নে। জননী পুনর্ণবার আশীর্বাদে বার বার পুনৰ্ণায়ণ।
.
কল্লোল-গোষ্ঠীর নৃপেনকে আমার কেমন যেন অলৌকিক বলে মনে হোতো। অবশ্যি অলৌকিকত্ব ছিল ওদের প্রায় সবারই-অচিন্ত্য, প্রেমেন, বুদ্ধদেব। আর বিশেষ করে ওই কাজীর তো বটেই। অলৌকিকতার প্রাচুর্যে সে ছিল যৎপরোনাস্তি!
অবশ্যি লেখক শিল্পী মাত্রেরই অলৌকিকতার সহিত কিছু না কিছু সম্পর্ক থাকেই-যে সূত্র থেকে তারা প্রেরণা পায়, রচনার মালমশলার যোগান আসে-সৃষ্টি করে। দৈনন্দিন। জীবনে যে ভাগাড়েই ঘুরে মরুক না, যাতে করে লেখার বা আঁকার কালে, নিমেষের ম তারা এক রীয় লোকে উঠে যেতে পারে-স্রষ্টার একাত্ম হয়ে যায়। সেই রহস্যের রহস্যময়তার কোনো ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না।
সেই অলৌকিকতা তো নৃপেনের ছিলই, তার অল্পদিনের জীবনেই কী আশ্চর্য শিশুসাহিত্য—যা নাকি দক্ষিণারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোরের রচনার মই অপরূপ–দিয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু শুধু সেইজন্যেই আমি বলছি না, অন্য অর্থেও সে অলৌকিক।
সে কোনো লৌকিকতা বা বাস্তবতার ধার ধারত না। এদিক দিয়ে সে খানিকটা নজরুলের সগোত্রই ছিল। পাক্কা বোকেমিয়ান।
সেদিনের মৌচাকের প্রথম প্রাপ্তিযোগের পর কলেজ স্ট্রীট ধরে আসছিলাম, পথের মোড়ে নৃপেনের সঙ্গে দেখা।
ভারী মুশকিলে পড়েছি ভাই! তোমার কাছে টাকাকড়ি কিছু আছে নাকি? দিতে পারো আমায়? অবশ্যিই ধার হিসেবে।
উসকোখুসকো চুল, উসখুস ভাব, অদ্ভুত চেহারা নৃপেনের।
বললাম, আছে কিছু যৎসামান্যই। এই মাত্তর মৌচাকের থেকে একটা গল্প লেখার দরুন পেয়েছি–এই পনের টাকা।
হঠাৎ বরাতের এই-খোলতাই খোলসা না করে পারা গেল না।
দেখি। বলেই সে টাকাটা আমার হাত থেকে যেন ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল।
আরে, আরে! আমারো যে টাকার দরকার হে। কিছুই নেই আর, আমার কাছে।
বলতেই সে পাঁচ টাকার নোটখানা ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। আর, পকেটের ভেতর থেকে এক গোছা নোট বার করে তার ওপরে আমার দশটাকিয়াটাকে গচ্ছিত করেছে।
এত টাকা তোমার। তার ওপরেও ফের তুমি টাকা চাইছো? আশ্চর্য! আমি অবাক হই সত্যিই।
কালকে আমার অনেক টাকার দরকার তা জানো? অনেকের কাছ থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এই মাত্র যোগাড় করতে পেরেছি। কাল শনিবার, তুমি জানো না?
শনিবার তো কী!
শনিবার মাঠে রেস হয় জানো না? রেসকোর্সে যাওনি বুঝি কখনো? ঘোড়দৌড় দ্যাখোনি নাকি?
দেখব না কেন? সে আর মাঠে গিয়ে দেখতে হয় না। সিনেমার হলে বসে পর্দাতেই বেশ দেখা যায়।
রেসের ব্যাপারটা জানো তাহলে মোটামুটি?
জানব না কেন? পৃথিবীতে দুটি মাত্র রেস, হিউম্যান রেস আর হর্সরে। আমার জানা আছে বেশ। আর এও জানি যে, এই দুই রেসের মধ্যে দারুণ রেষারেষি। মানুষরা যায় ঘোড়াদের নিজেদের পথে আনতে, আর ঘোড়ারা তাদের পথে বসিয়ে দেয়। কে না জানে?
তা যদি জানা থাকে তাহলে ভালোই জানো যে, এত টাকার একটাও কাল মাঠ থেকে ফিরে আসছে না। অতএব…অতএব… সে একটু ঢোঁক গিলে কয়, তোমার এ টাকা কোনোদিনই শোধ হবার নয়। সে অকপট হয়।
সেটা আমি ভালই জানতাম। ঋণ স্বভাবতই অপরিশোধ্য–সবার ঋণই–সব সময়েই। এমন কি আমিও যদি ওর কাছ থেকে দশটা টাকা নিতাম কোনোদিন, তা আর শুধতে পারতাম না ঠিকই। সেই কপ্পা বলে ওকে সান্ত্বনা দিতে চাই।
এবং তার পরেও বলতে যাই, সদুপদেশছলেই–টাকাটা জমিয়ে রাখলে কাজ দিত ভাই। নিদেন, মাঠে ফেলে অবে উড়িয়ে না দিয়ে ঐ টাকার রাবড়ি খেতে যদি-।
বাজে বোকো না… কে দেয় সে-ই আমায় টাকা কি রাখা যায় নাকি? রাখতে পারে কেউ? টাকা উড়বার, ওড়াবার, উড়ে যাবার-কখনই থাকবার নয়। জানো ভাই?
টাকার এ রহস্য আমার অজানা ছিল না। সকলেই জানে। ট্যাঁকে খুঁজে রাখলেও তারা থাকে না, উপে যায় কি করে যে! মাথায় করে রাখলেও থাকবার নয়। হাওয়া হয়। হাতে থাকতে থাকতেই বেহাত হয়ে যায় কেমন করে কখন! এমনি করে হাতাহাতি হয়ে বেহাত হতে হতে তার যাতায়াত।
যাক্, এই দশ টাকার জন্য তুমি দুঃখ কোরো না। এ টাকাটা ফেরত না পেলেও তোমাকে অন্য ব্লকমে আমি পুষিয়ে দেব। সে আশ্বাস দেয় আমাকে।
তা, পুষিয়ে দিয়েছিল সে সত্যি। দশ টাকার দশগুণ বললে কমিয়ে বলা হয়, একশ গুণ। বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না-হয়তো পাঁচশ গুণ হতে পারে সাত-পাঁচ জড়িয়ে।
তার কাছ থেকেই রেডিয়োর প্রথম আমন্ত্রণ আসে আমার–তার নিজের গল্প দাদুর আসরে গল্পপাঠের। এবং তার পর থেকে আসতেই থাকে। এবং এক খাসি পাঁচবার জবাই করে–যেটা করা নাকি আমার স্বভাব–সেই একদা রেডিওপঠিত গল্পই (কজন কান দিয়ে শোনে আর? আর শুনলেও মনে করে রাখতে পারে? ভূ-ভারতে এমন শ্রুতিধর কে আছে?) পরে পত্রিকায় ছেপে বই-এ বার করে পাঁচ গুণ লাভ কি আর হয়নি আমার? এইভাবে এনতার কামিয়েছি। সেদিক দিয়ে ধরলে প্রায় পুষ্যিপুত্ত্বরের মতই আমার নিয়মিত খোরপোষের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সে।
যদিও আমার এমনি বরাত, ভাগ্যের অনুগ্রহ লাভের সাথে সাথে বিড়ম্বনাও থাকে বুঝি তার হাত ধরে।
বেতারের আসরে প্রথম পদক্ষেপেই বিপর্যয় ঘটলো আমার।
নৃপেনের জরুরি চিঠি পেলাম হঠাৎ-বেতারের কার্যালয়ে তার সঙ্গে মোলাকাত করতে বলছে তৎক্ষণাৎ।