কালোত্তীর্ণ এই অমৃতের সন্ধান পেতেই দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার দরকার। নইলে এই বাঁচার–এমন করে বেঁচে থাকার কোনই মানে হয় না জীবনের নানা বৃত্তে, বিভিন্ন বৃত্তিতে, সুখদুঃখের নানান দশায় দশমহাবিদ্যার বিদ্যমানতা দেখে জন্ম সার্থক করার জন্যই আমাদের জীবন।
এক কালের দুঃখ অপর কালে কেমন করে যে মুক্তির কারণ হয়! এক সময়ের তাবৎ বাধা আরেক সময়ে সর্বাত্মক মুক্তি হয়ে ওঠে-অঙ্ক কষার যত ভুল কেমন করে মিলে যায় শেষটায়! সকল অসংগতি মহাকালের সঙ্গমে সঙ্গত হয়ে যায় যেন।
তখনই টের পেতে বাকী থাকে না, সেকালের সেই ক্ষণিকের খেদোক্তি-শিশির ভাদুড়ি নহ, বোতলের তুমি-কালোত্তীর্ণ হয়ে এই শেষ অঙ্কে এসে বাঁচালো আমাকে।
বুঝতে পারি, যার পেটে যেমন ধরে, যতটা হজম হতে পারে, অন্নপূর্ণার ভাঁড়ারে তার তেমন ভর ব্যবস্থাই। মহাকাব্যের কবি, মহানাট্যকার হবার জন্য সবাই নয়, মহাকাশের গ্রহ-উপগ্রহ সবাই হয় না, কিন্তু বৃহৎ বিপুল পরিক্রমার দারুণ পরাক্রম না থাকলেও হয়, কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। ছোট্ট বৃত্তের সামান্য বৃত্তিতেও সমান সার্থক হওয়া যায়। একই আনন্দ মেলে। কবির কথায়, যেমন লাগে সোনার বাটির পায়েস/ সেই মিষ্টান্ন ভাঁড়ে হলেও দিয়ে থাকে তেমনিতরই আয়েস। কিছু মাটি হয় না, যেহেতু পরমান্নটাই খাঁটি। সেইটাই আসল। আসলে ভূমাতেই সুখ-আর কিছুতেই নয়কো। স্বভূমি পেলেই সেটা মেলে। নিজের ভূঁইয়ে দাঁড়িয়ে মার সঙ্গে যুক্ত থাকা, সেই যোগাযোগই ভূমাতাতেই পরমানন্দ।
মহাজ্যোতিষ্কের গগনবিদার উদার অভ্যুদয় যেমন সার্থক, সেই সার্থকতা ক্ষণদীপ্তির জোনাকিরও।
মহাকাশের বিরাট জ্যোতির্লিঙ্গ নাই হওয়া গেল, দুঃখ কিসের! ক্ষণকালের জোনাকির স্ফুলিঙ্গ হয়েও সুখ আছে।
সময়ের অঙ্কে যেমন সব মিলে যায়, তেমনি মিলিয়েও যায় সব যথাসময়েই। যেমনটা ওই জোনাকিরা, তেমনি সূর্যতারাও কালের ফুৎকারে ফুক্ত হয়ে যাবার। সব আঁকের সমস্ত আঁকুপাঁকুরই শেষ ফল শূন্য-এড়াবার যো নেই।
মহা মহা ঐরাবৎ ডাইনোসেরাসও কালের গর্ভে কবে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু সেকালের সেই ছোট্ট চড়াইটি মহাকালের পারাবার পেরিয়ে একালেও হাজির।
আমার গল্প নয়, কবিতা নয়, উপন্যাস নয়, শিশির ভাদুড়ির দৌলতে পাওয়া আমার সেই এককথার চুটকিটাই আমায় উতরে দিয়েছে!
চুটকি লেখার এই চটক।
.
৭৭.
বিশ্বামিত্র তিনটি ছত্রে/ লিখিলা গায়ত্রী/ চুটকী বলিয়া পাইলা না ঋষি ফলারের পাত্রী/ হোথা শ্লোক তিনটন/ লিখি মিলটন/ অমর হইলা ভবে/ লোকে পড়ে কি না পড়ে জানেন বিধাতা/ হরি হরি বল সবে। কবে লিখে গেছেন কবি সত্যেন দত্ত।
সেই চুটকি লিখেই আমার এই ফলাও কারবার আবার! সাহিত্যলোকের কোনো এলাকায় একছত্র আধিপত্য না করেও এক ছত্রের এই ছত্রপতিত্ব!
মূকং করোতি বাঁচালম/পঙ্গুং লঙয়তে গিরিং-জাতীয় একটা মিরাক বলেই মনে হচ্ছে আমার। ফুটপাথের কেয়ার অফ যে-যার নাকি কবেই সেখানে পর্যবসিত হবার কথা, চড়াই পাখির মতন চুটকির পাখায় ভর করে ফুরুৎ ফুরুৎ তারই আবার মস্ত বাধার পাহাড় ওতরাবার ব্যাপার? এমন কাণ্ড কার? যে নাকি করে শহীদ হয়ে যাবার, তাকে যে এতদিন ধরে এতজনের এমন স্নেহ ভালোবাসা সইতে হল–এসব তো তার পাবার কথা ছিল না!
তিনটনী বোঝা নামিয়ে মিলটনী অমরত্ব লাভের কামনা কোনদিনই আমার ছিল না, তেমন ক্ষতাও নাস্তি, বিরাট বড়ো কিছু না হয়ে কেবলমাত্র শুধু আমি-হতেই আমি চেয়েছিলাম। আমার মাও বলেছিলেন সেই কথাই।
বলেছিলেন, কোনো কাজই বড় নয়, ছোট কাজ বলেও নেই কিছু-জগন্মাতাকে মনে রেখে যে কোনো কাজে প্রবৃত্ত হওয়াটাই আসল কথা। আসল কাজ।
প্রাণপণে চাওয়া বহু বাসনার সমাধির পরে–তারই ছাই উড়িয়ে এই সোনা পাওয়া যায়–সত্য হওয়া যায়–সুন্দর হওয়া যায় স্বচ্ছন্দে। মনোবৃত্তির পথ ধরে এগুলেই হয়। সহজেই হওয়া যায়। মায়ের সাহায্য মেলে। পদে পদে হাতে হাতে তাঁর মোলাকাত পাই।
মাতৃভূমির মূল থেকে বৃত্তপথের জন্মভূমিতে মুহুর্মুহু জন্মজন্মান্তরের আমূল বৃত্তান্ত! জীবনভোর মিলিয়ে দেখা যায়।
সেই কৈশোর কালে যে পত্রিকার হকারি থেকে শুরু করেছিলাম, এই অন্তিম দশায় সেই পত্রিকাতেই কলমদারি–আশ্চর্য যোগাযোগ না?
প্রাণপণে চাওয়া বহু বাসনার সমাধির পরে–তবেই ছাই উড়িয়ে এই সোনা পাওয়া, হারে ধুলো মুঠি সোনা মুঠি হয়ে যাওয়ার মতই এসব কার কেরামতি?
সেই মারই তো!
যাঁর হঠকারিতায় হঠাৎ হঠাৎই মিলে যায় সব, তাঁর হস্তগত (কিংবা শরণাগতই বলুন!) লেই সব হয়।
এই বোধি লাভই জীবনের সত্যিকার পাওয়া। এর হেতুই আমাদের জন্মানো, জীবন-পন, সুখ-দুঃখে দীর্ঘদিন ধরে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকা।
নিজের ভুঁয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে যে যোগাযোগ তাই ভূমাতাতেই সুখ-সুখের সঙ্গে শান্তি সোয়াস্তি স্বাচ্ছন্দ্য। সেই স্বভূমিতেই, বলেছিলেন মা, তার বৃত্ত ( বা বৃত্তি) বড় হোক ছোট হোক–সেই স্বরাজ্যে সবাই সার্বভৌম। বৃত্তই আসল, কেন্দ্রমূলের সমমূল্য, মূলকেন্দ্রের সমতুল্য। এবং সদা-সর্বদা এই প্রবৃত্ত থাকাটাই আমাদের জীবনবৃত্তান্ত!
এই বোধিই সত্য। জন্ম-জন্মান্তরে এই বোধিই আমাদের পেতে হয়। সেই বোধিসত্ত্ব হওয়াটাই লক্ষ্য আমাদের-তাই সবার নিয়তি।