যদিও শেষ পর্যন্ত পারেনি, হার মেনেছে। তাই রক্ষে।
মানুষ বুঝি কাউকেই করা যায় না, যে হয় সে আপনিই হয়। কারো প্রচেষ্টায় কেউ হবার নয়।
অশোকবাবুর কাছ থেকেও সেই প্রাণতোষিণী প্রস্তাব এল আবার। আমার সেই এক লাইনের মার। ওস্তাদি মার নয় যদিও। তথাপি তিনিও তাই চাইলেন।
কিসের থেকে কী গড়ায় দেখুন! এককালের অভিশাপ, আরেক কালের অভিবাদনে দাঁড়ায়।
মানুষের বরাতে শাপই বর হয়ে দেখা দেয় বারে বারে–তাই বোধহয় তার বরাদ্দ! যেটাকে আমরা একদা বঞ্চনা বলে জ্ঞান করি, পরে দেখা যায়, সেটাই আমাদের বেঁচে যাওয়া। সবার অভিজ্ঞতাই তাই বলে বোধ হয়, এমন কি কবির অভিজ্ঞানেও তার পরিচয় রয়েছে। বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই/বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে/এ কৃপা কঠোরসঞ্চিত মোর/জীবন ভরে /…সেই কথাই কয় নাকি? সবার মতন আমার জীবনেও কিছু তার অন্যথা হতে পারে না। হয়ওনি।
এবং সেইজন্যই এ জীবনে মানুষ হতে না পারলেও আমি যে আমি হতে পেরেছি এই আমার ঢের। কিছু না হয়েও কিছু হয়ে ওঠা–কবিকথিত অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর মতন সকল ভালো-মন্দর মধ্যে বিরাজিত ভালোর মতন তাবৎ দ্বিধা দন্দ্বের অতিক্রম না-করার মধ্যে এই আকার নেওয়াটাই বুঝি চরম। এর জন্য যাঁর কাছে পেয়েছি এবং যাঁদের কাছে পাইনি, সবার প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ।
হেমেন্দ্রপ্রসাদের আশীর্বাদের ন্যায় শিশিরবাবুর অবদানের জন্যও আমি কৃতার্থ। কিছু না হারালে কিছু মেলে না দুনিয়ায়। এবং যে-হারটা মানতে হয় তার ভেতরেই জয় যেন প্রচ্ছন্ন থাকে–ইংরেজি বাংলা দুই বানানেই।
শিশিরকুমার মহানুভব ছিলেন সন্দেহ নেই। সবার প্রতিই তাঁর সহানুভূতি ছিল। ইচ্ছে করে কাউকে তিনি বঞ্চনা করতেন না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু কার্যক্রমে কখনো কখনো তা হয়ে যেত যে, সেটা তাঁর দোষ নয়। থাকলে পরে, থাকা পর্যন্ত তিনি ঝেড়ে কুড়ে দিয়ে দিতেন। সেদিন যে ব্যাঙ্কের পাশবই দেখে তাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্টে মাত্র ১২০ টাকা পেয়ে, তার সবটাই–সেদিনকার মতন তার যথাসর্বস্বই, আমায় দিয়েছিলেন, তা। আমি বিশ্বাস করি।
বরং বলা যায়, তাঁকেই অনেকে নানাভাবে বঞ্চনা করেছিল, তাঁর প্রাপ্য তাঁকে দেয়নি। কিন্তু তাঁর এই বঞ্চিত হওয়াটা অপর কারো প্রবঞ্চনায় নয়, বরং তাঁর নিজগুণেই। এবং কিছুটা আত্মজনের, আর কিছুটা-বা পরের গুণফলে।
তিনি কারো ধার করে তারপর আর শোধ করতেন না, সেলুনে দাড়ি কামিয়ে পয়সা দিতেন না পর্যন্ত, বা মুদীর দোকানের দেনা মেটাননি বা যে দোকান থেকে মদ কিনতেন, তারও দাম দিতেন না কোনদিন, বলে সে নানা গুজব শোনা যেত তার সবটাই হয়ত সত্যি নয়।
উলটে, তিনি কারো বিশেষ ধার ধারতেন না, এই কথাই বলা যায় বরঞ্চ।
এমনি করেই মনে হয় ঘটনাগুলো ঘটে যেত–যার ফলে নাকি ওই ধারার রটনা।
কখনই পকেটে টাকাপয়সা নিয়ে বাড়ির বার হতেন না মনে হয়, যেটা নাকি বিস্মরণশীল সম্ভ্রান্ত প্রতিভার সহজাত।
সেলুনে দাড়ি কামিয়েছেন, পয়সা দিতে গিয়ে দেখেন নেই। সেলুনওয়ালা তাঁকে আশ্বস্ত করেছে-তাতে কী হয়েছে! আপনি আমাদের দেশের গৌরব! আপনাকে কামাতে পেরে আমরা কৃতার্থতারপরও আরও কিছু না-ই কামালাম।
মুদীও তাই করেছে, মদওয়ালাও তাই।
আপনাকে কিছু দিতে পেরে আমরা ধন্যতার জন্য দাম আবার কী নেব? বলেছে সবাই।
কিন্তু কেউই তারা মুদিত হবার পাত্র ছিল না, স্বার্থচেতন ছিল সকলেই, যথাকালে পরম্পরায় তারা দেখা দিয়েছে-পয়সার জন্য নয়, পাশের জন্য। প্রমোদিত হবার জন্যই।
এবং শিশিরকুমারও তা না দিয়ে পারেননি।
আর, এই করেই এত এত পাশ কাটার সাথে সাথে থিয়েটারী ব্যবসাও তাঁর পাশ কাটিয়েছে–তাঁর পাশ থেকে কেটে পড়েছে কখন। নইলে যে-ব্যবসায় সেই কালেরই মনোমোহন পাঁড়ে অগাধ টাকা উপায় করেছেন, সেই কালেই নব নাট্যযুগের পাণ্ডা (নাকি আরেক পাঁড়ে? বা পাঁড় ) হয়েও অসংখ্য লোকের মন মোহিত করেও সেই পথেই শেষপর্যন্ত তিনি সর্বস্বান্ত!
দুঃখ হয় নাকি? তাঁর জন্যই হয়।
আমার নিজের জন্য তেমনটা নয়। কেননা তাঁদের এই প্রতিকূলতার আনুকূল্য না পেলে কখনই আমি আমার কূলে এসে ভিড়তে পারতাম না। তাঁদের সেই নামমাত্র অনুদানের সাহায্যও কিছু কম নয়।
জীবনে সব কিছুরই প্রয়োজন আছে। যেমন প্রিয়জনের তেমনি বিরূপজনের। সৌহার্দ্য ভালোবাসা বাধাবিপত্তি সব কিছুই জীবনে সত্যি–সব জড়িয়ে মোট মূল্যেই সার্থক।
সবই আমাদের এগিয়ে দেয়–যাত্রাপথের পাথেয় যোগায় সকলেই।
কালক্রমেই সেটা জানা যায়। তখনই বোঝা যায় যে, সুবিস্তৃত মহাকালের বুকে নৃত্যপরা মহাকালীর লীলা খেলায় একদিকে যেমন তাঁর মস্ত খঙ্গ, অন্যদিকে তেমনই তাঁর অভয়হস্ত। এক হাতে ধৃত যেমন আমার ছিন্নমস্তক, তার কাছাকাছিই অপর হাতে ধরা আমার জন্য তাঁর বরমাল্য!
তাঁর এই কালীয়দমনকাণ্ডে সময়-মন তাবৎ হলাহল–জীবনে যা হল আর যা হল না–সবকিছুরই পরম অমৃতায়ন-যথাকালেই জানা যায়। কালক্রমে হতে থাকে। সকলের জীবনেই-কোনো তার ইতরবিশেষ হয় না কখনো।
জীবনের আঁক কষতে গিয়ে, শেষপর্যন্ত দেখি, যা নাকি কিছুতেই মেলেনি, যত না গরমিল আর অমিল ছিল, সমস্তই মহাকালের কোলে এসে কেমন করে যেন মিলে গেছে। মাতৃঅঙ্কে এসে মিলে যায় সমস্ত জীবনের যত আঁকিবুকি সব মিলিয়ে চমৎকার ছবি হয়ে দাঁড়ায়। সেই অঞ্চন আর কারো নয়, মার আপন হাতের।