সেই নব নব রূপে অপরূপ মুক্তি।
আর এই রূপই হল আমার অভিশাপ। এই রূপের জন্যেই জীবনে আমার কিছু হল না এবং যা কিছু হল তা হয়ত ওর জন্যেই হল। এই অনির্বচনীয়ের স্বাদ বাল্যকালেই আমি পেয়েছিলাম আর তার টানে সেই অতি কৈশোরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির থেকে স্বাধীনতার সাথে শুধু কেবল বহুবিচিত্র রূপের আস্বাদে।
মুক্তির রূপ আর রূপের মুক্তি এক হয়ে মিশে গেছে আমার জীবনে।
এই কারণেই আয়াসসাধ্য কোনো সাধনা আমার দ্বারা হল না, সাধনালব্ধ কোনো সিদ্ধিও নয়। এমন কি, লিখে লিখে জীবনটা কাটলেও লেখকের মত লেখক আমি হতে পারলাম না কোনোদিনই। লেখক হতে হলে যে উদয়াস্ত পরিশ্রম বা নিদারুণ পড়াশোনা বা যে দুর্নিবার দুঃখ ভোগ করতে হয় তা আমার কুন্ঠিতে কই?
লেখক হতে চাইওনি বোধ হয় আমি। লিখতে ভাল লাগে না আমার। প্রেরণার বশে নয়, প্রাণের দায়েই, আর কিছু না হতে পেরেই অগত্যা আমার এই লেখক হওয়া–সাংবাদিক হতে গিয়েই লেখক। ঘরকুনো হয়ে ঘাড় গুঁজে কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে লেখক হবার কোনোদিনই আমার সাধ ছিল না, পাঠক হতেই চেয়েছিলাম বরং। বিধাতা সে বর্ণপরিচয়ের কেতাব আমাদের চোখের সামনে চারিধারে মেলে রেখেছেন সর্বদাই, যার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে মুক্তোর ছাঁদে সোনার আখরে আপন স্বাক্ষরে তাঁর অপরূপ কাহিনী লেখা, নতুন নতুন হরফে নব নব মুদ্রণে মুহূর্তে মুহূর্তেই যে–বইয়ের নিত্য নবীন সংস্করণ, সেই-বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের পড়াই আমার শেষ হয়ে উঠল না জীবনে। লিখিয়ে হব কি, পড়ুয়া হয়েই থাকতে হল আমায় চিরটা কাল। কি সেই ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারলুম কি?
.
যে তিনটি কথা মাথায় করে আমার এই আত্মকাহিনীর শুরু, সে-তিনটির সঙ্গেই, যাকে বলে কমফ্রন্টেশন, সেই বাল্যকালেই আমার হয়েছিল।
সত্যি বলতে, সে সময়টা ছিল কেমন ঈশ্বরপীড়িত। আমাদের বাড়িতে বাবা ছিলেন পরম বৈষ্ণব, বিষ্ণুভক্ত; মা ছিলেন শাক্ত, শক্তির উপাসিকা; আর আমার মামা ছিলেন নাম-সাধক, হরিগুণ গানে বিভোর।
বাবাকে আমার মনে হত মহাদেবের মতন। শিবের মতই ছিল তার চেহারা আর ধরনধারণ। রক্তাভ গৌরকর্ণ চেহারা, সদাপ্রসন্ন, প্রশান্ত, আত্মনিমগ্ন। সংসার-উদাসীন আত্মভোলা। ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম ভাঙত তাঁর। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি গোটা গীতাটা আওড়াতেন। তাঁর মুখে শুনে শুনেই গীতা আর উপনিষদের আদ্ধেক শ্লোক আমার মনে গাঁথা হয়ে গেছল– মানে তার বুঝি আর নাই বুঝি। সেই পুঁজিই আমার সারা জীবন ভাঙিয়ে খাওয়া।
মার কাছে প্রায়ই আসত লাল চেলীপরা ত্রিশূলধরা ভৈরবীরা–তিব্বতের কোন মঠ না কামিখ্যে থেকে কে জানে! মার সঙ্গে নিভৃতে আলাপ হত তাঁদের। দিনকতক থেকে ফের কোথায় তাঁরা চলে যেতে যেন।
এক ভৈরবী আমায় ভালোবাসতেন ভারী। পেড়া-টেড়া খেতে দিতেন তার বোলার থেকে। দেবী কামাখ্যার মহাপ্রসাদ। তিনি একবার আমায় বলেছিলেন-তোমার মাকে সামান্য মনে কোরো না বাবা। জগন্মাতার অংশ আছে তার মধ্যে। মাকে কখনো অমান্য কোরো না।
মাকে আমি ভালোবাসি তে।
মা সাক্ষাৎ ভগবতী। মা-ও যা–মা দুর্গাও তাই। তিনি বলতেন।
জানি আমি। জবাবে আমি বলতাম–সবার মা-ই তো তাই। মা দুর্গাই। তাই না?
শুনে শুনেই এসব কথা জানা। আমিও শুনিয়ে দিতে ছাড়তাম না।
তাই বটে। তবে তোমার মা আরও বিশেষ।
কিন্তু কী যে সেই বিশেষ তা তিনিও কোনো দিন খুলে বলেননি, আমিও তা জানতে চাইনি কখনো। মার সেই বিশেষত্ব সারা জীবন ধরে আমায় জানতে হয়েছে। জীবন ভরে জেনেছি। আর, পৃথিবীর সঙ্গে আমার মুখোমুখি হয়েছিল সেই বয়সেই। মাথার মধ্যে কী পোকা ছিল কে জানে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোতো, আর মাঝে মাঝেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম বিবাগী হয়ে। পকেটে একটিও পয়সা না নিয়ে পাব কোথায় পয়সা?) বিনাটিকিটে রেল গাড়ির লম্বা লম্বা পাড়ি জমাতাম-চলে যেতাম বৈদ্যনাথধাম। দেওঘরের দেবতা কি প্যাড়া কিসের টানে তা আমি বলতে পারি না।
চলে এসেছি কলকাতায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, খবরকাগজ ফিরি করেছি, জেল খেটেছি মাঝে মধ্যে, ফুটপাথে পার্কে শুয়ে রাত কেটেছে। কষ্টের মধ্যেও কতো সুখ। স্বাধীনতার স্বাদ।
আর, ভালবাসা? তার পরিচয় কাউকে বোধ হয় চেষ্টা করে পেতে হয় না, সে নিজেই আগ বাড়িয়ে জানান দিয়ে থাকে। ই একটি বস্তু, যা কারোর দ্বারা কিছুতেই লভ্য নয়, (পাওয়াও যায় না বোধ হয়) নিজগুণে আপনার থেকে অযাচিত এসে ধরা দেয়।
চলার পথের মোড়ে মোড়েই তার দেখা মেলে। দেখতে না দেখতেই বেঁচে উঠি, বেঁচে বেঁচে যাই। নতুন করে বাঁচি, নতুনতরো আঁচ পাই জীবনের। কি করে যে একজনকে আরেকজনের এমন ভালো লেগে যায়, আর কী আশ্চর্য, তাকেও ভালো লাগানো যায় তেমনি আবার–কত সহজেই না! আমার কাছে সে এক পরম বিস্ময়-পরামাশ্চর্য রহস্য:
ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা–প্রত্যেকের জীবনেই ওতপ্রোত। কেউ বঞ্চিত নয়। প্রত্যেককেই টের পেতে হয় কখনো না কখনো, না টে: পেয়ে উপায় নেই, যিনি এই নাটের গুরু তিনিই টের পাওয়ান।
আর, বাল্যকালেই এসবের টের পেয়ে যাওয়া এক রকমের ভালোই বোধ করি। কেননা, ব্যাধি হিসেবে এই তিনটিই মারাত্মক–এই ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা। তেমন করে ধরতে পারলে এ বস্তু কাউকে ছাড়ে না, রেহাই দেয় না সহজে, আজীবন ভোগায়, আপাদমস্তক গ্রাস করে বসে। সংসার, সারাৎসার আর…আর ভালোবাসার কী আখ্যা দেব? অন্তঃসার? নেহাৎ অন্তঃস্রাব ছাড়া কী আর ও? এর একটিই যদি কাউকে ধরে তো তার হয়ে গেল। জীবনের মতন ছাড়ান নেই। ঘোর সংসারী, যোরালো প্রেমিক কিংবা ঘোরতর ঈশ্বরসাধক হয়ে গেল সে। হতেই হবে। পরিত্রাণ নেই আর।