সে ফ্রকটা খোলে। খুলে একটুখানি হাসে-হলো তো এবার?
বারে! কোথায় হলো?
তখন সে ইজেরটাও খুলল আস্তে আস্তে।
কয়েক মুহূর্ত না হতেই লাজুক চোখে তাকিয়ে বলল–পরি এবার?
পর। সত্যি, তুই ভারী সুন্দর। তোর মতন সুন্দর মেয়ে আর হয় না। আমি তো কখনো দেখিনি।
কটা মেয়ে তুমি দেখেছ! সে হেসে বলে-জীবনে কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখতে পাবে। আমার চেয়েও ঢের ঢের।…তখন তো ভুলে যাবে আমাকে।
কক্ষনো না। আর কোনো সুন্দর মেয়েকে আমি দেখব না। দেখতেই চাইনে আমি। তুই-ই আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর। তুই একমাত্র।
ফ্রক-টক পরে সে এক দৌড়ে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল আবার।
কোথায় গেছেলিস?
দোতলায়। বাথরুমে।
তারপর সে আপনার থেকেই ফ্রক খুলল, ইজেরটা খুলে ফেলল আবার, না সাধতেই। আপনমনেই নাচতে শুরু করে দিল তারপর।
ছাদময় ঘুরে ঘুরে নাচল।
তুই এমন নাচতে শিখলি কোত্থেকে রে?
শান্তিনিকেতন থেকে। মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। থেকেছিলাম দিন কয়েক। দেখে দেখে শিখেছি। শান্তিনিকেতনের মেয়েরা নাচে সবাই।
তাই নাকি? আমি বললাম, বাঃ বেশ তো!
আর মেমরা কেমনতর নাচে জানো? ঠ্যাং তুলে তুলে এমনিধারা। কলকাতার সিনেমায় দেখেছি। কেন যে তার অমন ফুর্তি জাগল হঠাৎ কে জানে, ছাদময় খানিক ছুটোছুটি করে কার্নিশের ধার ঘেঁষে এমন করে সে দৌড়ে এল এক পাক যে, আমার বুকটা ধড়াস্ করে উঠল হঠাৎ-আটপকা নীচে পড়ে যেত যদি?
দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে কোলের ওপর বসে পড়ল সে। আমার মুখের মধ্যে তার মুখ গুঁজে রাখল।
তোর এত ফুর্তি যে হঠাৎ! আমি শুধাই-কেন রে?
এমনিই। তারপর একটুখানি চুপ করে থেকে–ভালো লাগল নাচতে তাই।
গান গাইতে পারিস নাকি?
হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ল সে–গাইব? বলে গুন গুন সুরে শুরু করল সে–দাঁড়িয়ে আছে তুমি আমার গানের ওপারে একটুখানি গেয়েই চুপ। বসে রইল চুপটি করে।
একদিন তোর পা থেকে মাথা অব্দি আমি চুমু খাব–বুঝলি?
খেয়ো।
হাজার হাজার।
আচ্ছা। কিন্তু পা থেকে কেন? পা কি চুমু খাবার জায়গা নাকি?
দেবতাদের পাবন্দনা করে আরম্ভ করতে হয় কিনা?
আমি দেবতা নাকি?
আমার কাছে তো।
আমিও তোমার পায়ে খাব তাহলে।
না। তা আমি খেতে দেবো না। একটুখানি থেমে বলি, ছেলেরা কেউ দেবতার মতন হলেও তাদের পাদবন্দনা করে শুরু করার নিয়ম নেই। তাদের মুখে খেলেই হয়।
খাবে পায়ে? সে তার ডান পা-খানা তুলল একটুখানি। পাখির ডানার মত।
আমি আলতো হাতে ধরে তার পায়ের পাতার ওপরে আমার চুমু রাখলাম।
তারপর কী হল যে, সে কান্নায় ভেঙে পড়ল কেন কে জানে! কোলের উপর বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে।
কী হল রে তোর? কাঁদছিস কেন?
কিছুতেই সে ঠাণ্ডা হয় না। কত আদর করলাম, ঠোঁট দিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দিলাম ওর-বুও না।
একটু বাদে কান্না থামলে সে চোখ তুলে তাকালো উত্তর আকাশে দেখা গেল কাঞ্চনজংঘা? দেখেছিলে?
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম।
আমি দেখতে পেলাম না। দুঃখের সুর বাজল তার স্বরে-দেখলে তো বললে না যে আমায়?
আকাশে দেখিনি। এই ছাদেই দেখেছি কাঞ্চনজংঘা।… আমি বলি–এখনো দেখছি।
অবাক চোখে তাকায় সে আমার দিকে–এখনো দেখছ
আমি বলি : কাঞ্চনজংঘার ছটা এখানে বসেই দেখছি এখন। এই তো!
দুষ্ট! লাজুক মুখে একটুখানি আদর করে উঠে পড়ল সে কোলের থেকে। ফ্রক-টক পরে মধুর হেসে চলে গেল তারপরে।
তারপরেও আমি বসে রইলাম অনেকক্ষণ সেই ছাদেই। অন্ধকার নামল, তারা উঠল। সারা আকাশ যেন তারায় তারায় রিনি রিনি করতে লাগল।
বিকেলে কিছু খাইনি তো, খিদে পেয়েছিল বেশ। লুচি আর বেগুন ভাজার গন্ধ আসছিল রান্নাঘর থেকে। ভাবলাম মার রান্নার একটুখানি বউনি করা যাক গিয়ে।
বউ নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল মা আর মাসিমার মধ্যে। দোর গোড়াতেই থমকে দাঁড়াতে
আসছে মাসেই দিদি আমরা চলে যাচ্ছি এখেন থেকে। বলছিলেন রিনির মা।
কেন দিদি, এখানকার জলহাওয়া কি সইছে না তোমাদের? মা বললেন।
তা নয়। মেয়েদের পড়াশোনা কিছু হচ্ছে না। কোনো মেয়ে-ইস্কুল নেই এখেনে। এখনকার কালে মুখ মেয়ে কি বিয়ের বাজারে চলে দিদি?
ইস্কুলের কোনো মাস্টারকে প্রাইভেট টিউটর রেখে দাও না কেন! বাড়িতে এসে পড়িয়ে যাবে মেয়েদের, ফাইনালের জন্যে তৈরি হোক বাড়ি বসে। তারপর কলকাতায় গিয়ে প্রাইভেট পরীক্ষা দেবেখন। তারপর মা অনুযোগ করলেন আবার : আর তাছাড়া, তোমার মেয়েরা তো দেখতে ভালোই। তেমন কিছু লেখাপড়া না জানলেও বেশ ভালো ঘরে বিয়ে হবে দেখো।
সেই বিয়ের কথাটাই ভাবছি দিদি। মেয়েরা সব ডাগর হয়েছে। নানু তত বলতে গেলে বিয়ের যুগ্যিই, ষোলো পেরুলল। তার ছোটটাও পনেরয় পড়েছে, রিনিও চোদ্দয় পা দিল। কলকাতায় আমাদের বাড়িঘর ইষ্টিকুটুম সবাই-এখানে বসে কি বিয়ের সম্বন্ধ করা যাবে।
এটা ভাবনার বিষয় ছিল বোধহয়, কেননা মাকেও একটু ভাবিত দেখা গেল।–তা বটে। নানুর বিয়েটা দিতেই হবে এবার। কিন্তু তোমার এই মেজো মেয়েটিকে আমার পছন্দ, ভারী ঠাণ্ডা মেয়েটি। বেশ লক্ষ্মীশ্রী।…
মেজো মেয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই, মায়ের পাশটিতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কথাটায় মাথা নীচু করল দেখলাম।
মা তার চিবুকে হাত দিয়ে আদর করলেন–বেশ মেয়েটি। রামের সঙ্গে বেশ মানাবে। এটিকে তুমি দেবে আমায়?