তবে পূর্ণযৌবনা সুন্দরীর রূপলাবণ্য হাতে হাতে পরখ করে দেখা আমার সেই প্রথম। সেই অল্প বয়সেই সৌন্দর্যবোধের শিক্ষাও আমার হয়ে গেছল।
তারপর রিনিদের বাড়ি আর না গেলেও সে-ই আসত আমার কাছে। বিকেলে বেড়ানোর বেলায় তো বটেই, অন্য সময়েও কোনো দরকার পড়লে চলে আসত সে।
তবে যেতে হলো আমায় তাদের বাড়ি সাত-সকালেই একদিন হঠাৎ।
বাবা কদিনের জন্যে কলকাতায় গেছলেন কী কাজে, ফিরেছিলেন আগের দিন রাত্তিরে। অনেক রাত তখন, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা।
কলকাতা থেকে নতুন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে এসেছিলেন বাবা আমাদের জন্যে। মা খুব ভালোবাসতেন নলেন গুড়ের সন্দেশ খেতে। কলকাতার মেয়েতো।
সকালে উঠে হাতমুখ ধুতেই না, মা দুটো বড়ো বড়ো তালশাস সন্দেশ খেতে দিলেন আমার। অমনি আমি সেই সন্দেশ হাতে করে ছুটেছি ওদের বাড়ি। রিনিকে ভাগ না দিয়ে খাওয়া যায়?
ওরা ভাইবোন মিলে তখন গুলতানি করছিল ওদের পড়ার ঘরে, আমি গিয়ে হাতের মুঠো খুলে রিনিকে দেখালাম-দ্যাখ, কি এনেছি তোর জন্যে।
তখুনি সে আমার হাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছে। দুটো সন্দেশই এক সঙ্গে।
ও মা! আমি যে একদম খাইনি রে এখনো।
বলতেই না, সে মুখ থেকে বার করে আমার হাতে নয়, পাখি-মা তার ছানাকে যেমন করে খাওয়ায়, তেমনি করে তার মুখের গ্রাসের খানিকটা আমার মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে। মুখের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে।
সেই প্রথম চুমো পাওয়া আমার জীবনে। সন্দেশের সঙ্গে মিশিয়ে চুমু খাওয়া সেই! প্রথম অমৃত আস্বাদের জন্যে রিনির কাছে আমি চিরঋনী।
প্রথম চুমু অমন করে সন্দেশের সঙ্গে মিশিয়ে পেয়েছিলাম বলেই কি ওই চুমু জিনিসটা এমন মিষ্টি থেকে গেল আমার কাছে চিরদিনই?
নাকি, চুমোর সঙ্গে মাখানো ছিল বলেই কি যতো মেঠাই এমন মিঠে লাগে আমার কাছে?
তাই কি আমি এমন সৃষ্টিছাড়া মিষ্টিশোর হয়ে গেলাম জন্মের মতই? কে জানে!
.
০৮.
সেদিন আমি ছাদেই ছিলাম বিকেলে। একটু বাদে রিনি এল।
কী! বেড়াতে বেরুবে না আজ?
না। ছাদে বসে বসে আজ কাঞ্চনজংঘা দেখব।
এখানে বসে কাঞ্চনজংঘা দেখা যায়? বসল সে।
হ্যাঁ, উত্তরের আকাশ পরিষ্কার থাকলে। আজ তাই আছে। সূর্যের আলো একটু কমে এলেই কাঞ্চনজংঘার ছটা দেখা দেবে। পাহাড়ের শৃঙ্গগুলো সারি সারি এমন সুন্দর দেখায় সারা উত্তর দিকটা জুড়ে কি বিরাট সমারোহ। বোস না আমার পাশে;খতে পাবি। দেখাব তোকে।
সে বসল বেশ কৌতূহল নিয়ে।
চিড়ে গুড নিয়ে আসি গে? খাওয়া যাবে। .
ও জিনিস কি ঘরে বসে বসে খাবার? বেড়াতে বেড়াতে খায়।
বেশ তো, বেড়িয়ে বেড়িয়েই খাওয়া যাক।
বেড়াবে কোথায়?
কেন, এই ছাদেই। কত বড় ছাদটা দেখেছিস। আমি রোজ সকালে উঠে এইখানেই বেড়াই তো। আমাদের এধার থেকে তোদের ওধার অব্দি বার আষ্টেক পাক খেলেই আধ মাইলটাক মনিং ওয়াক হয়ে যায়। এই ছাদেই। তুইও আসিস না তখন! বেড়িয়ে বেড়িয়ে পড়াও যাবে-পড়াও তৈরি হয় বেশ।
কি করে আসব বলো? আমাদের দিক থেকে ছাদে ওঠার কোন সিঁড়ি নেই যে!
একটা বাঁশের মই বানিয়ে দিতে পারি তোদের দিকে–মই বেয়ে তুই উঠতে পারবি?
সে কথার জবাব না দিয়ে সে বললে-কোথায় তোমার কাঞ্চনজংঘা? দেখাবে বললে যে!
দাঁড়া না, দেখবি। বোস না।
বসেই তো আছি। না, কাঞ্চনজংঘা আর দেখা দেবে না আজ। কেমন ধোঁয়াটে কুয়াশার মতন দেখছি যেন উত্তর দিকটা।
না দেখা দিক। তুই তো দেখা দিয়েছিস! তোকেই না হয় দেখব আজ। ভালো করে দেখব আরো।
দেখছই তো। আবার কী দেখবে আমায়!
এ দেখা নয়, ভালো করে দেখব তোকে। আমার সামনে খালি গা হবি?
দূর! তা আবার কেউ হয় নাকি?
সুন্দর মেয়েরা হয়। আর্টিস্টের সামনে হয়ে থাকে। দেখে দেখে তাদের ছবি আঁকে যে তারা। এমন সব খালি গায়ে মেয়েদের ছবি তোকে আমি দেখাতে পারি। বিলিতি অ্যালবামে আছে।
ও! সেই বিলেতেই হয়, এদেশে নয়। সে বলে।
এদেশেও হয়েছে। এদেশের আর্টিস্টরা ছবি এঁকে চিরদিনের মত ধরে রেখেছে তাদের। দেখতে চাস্?
না। দেখে কী হবে? দেখবার কী আছে ওতে?
দেখতে সুন্দর! দেখতে চমৎকার! দেখলে আনন্দ হয়। এই! আবার কী! আমি বলি-তোকেও সেই রকমটি আমি দেখতে চাই।
দেখে কী করবে? তুমি তো আর আঁকতে পারবে না।
মনের মধ্যে একে নেব–চিরকালের মতই।
দেখছ তো! অনেকখানিই দেখছ! মুখ দেখতে পাচ্ছ–কতটা পা দেখতে পাচ্ছ দ্যাখো। এই তো! এতখানি ফ্রকটা তুললাম…দ্যাখো না!
না আমি সবটা দেখতে চাই।
সবটাই তো দেখছ। আবার কী আছে দেখবার?
আরো সব। আমি বললাম-তুই দেখতে সুন্দর না? দেখতে ইচ্ছে করে না আমার?
আর কোনো মেয়েকে তুমি দেখেছ এমন খালি গায়ে?
আবার কে আছে দেখবার? আমি বলি, আবার কে সুন্দর আছে এখানে?
কেন, আমার দিদি! সে তো আমার চেয়ে অনেক সুন্দর।
মোটেই না। আমার কাছে নয়, আমার কাছে তুই-ই কেবল সুন্দর, তোকেই দেখতে চাই।
আমি যদি খালি গা হই তুমি দিদিকে বলে দেবে না তো?
পাগল! তা কি কেউ কাউকে বলে নাকি?
সে চুপ করে থাকে, কী যেন ভাবে।
ছাদে কেউ এসে পড়বে না তো হঠাৎ?
কে আসবে?
মাসিমা, কি তোমার ভাই?
মা তো জলখাবারের লুচি ভাজছেন এখন। আর সত্য? সে এখন নানুর সঙ্গে মার্বেল খেলছে উঠোনে।
তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না তো? ছোঁবে না তো আমায়?
কক্ষনো না। তুই সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকিস। খালি এক মিনিটের জন্যে কেবল। খুলবি আর পরবি।