যদিও মাঝে মাঝে আমার মনে হয় জীবনের যত ভূয়োদর্শনের সবটাই হয়ত ভুয়ে নয়।
.
০৭.
রিনিকে নিয়ে আমি প্রায় দিনই বেরিয়ে পড়তাম বিকেলে বেড়াতে। ইস্কুলের থেকে ফিরে দুপকেটে চিড়ে আর খেজুর গুড়ের পাটালি ভরে নিয়ে কুকুরডিঘির পাশ দিয়ে পাহাড়পুরের পথ ধরে চলে যেতাম একেকদিন। দুজনে মিলে চিড়ে গুড খেতে খেতে মজা করে। কোনোদিন বা আবার চষা ক্ষেতের আল পথ দিয়ে আলগোছে হাঁটতাম আবার আমরা। কোনোদিন নয়া দিঘির পাড়ে বসে থাকতাম, বসে বসে গল্প করতাম দুজনায়।
মাঠের মাঝখানে সেই যুঁই গাছটার তলায় গিয়ে বসতাম একেকদিন। যুঁই ফুল ছড়ানো কেমন গন্ধ জড়ানো জায়গাটা। সেখানে গেলে রিনির সব গল্প ফুরিয়ে যেত হঠাৎ। আমার কোলের ওপর মাথা রেখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভাবত সে, কে জানে! তার মুখের ওপর চোখ নামিয়ে কী দেখতাম আমি কী জানি!
সারা আকাশ রঙে ভাসিয়ে দুর দিয়ে সূর্য অস্ত যেত, আর যে সূর্যমুখী ফুল আ। চিনিনে, দেখিনি কখনো, কি রকম দেখতে কে জানে, আমার মনে হত তাই যেন ফুটে রয়েছে আমার কোলের উপরে।
কোনোদিন বিকেলে আমি ডাকতে যেতাম রিনিকে ওদের দিকটায়। কোনোদিন বা সে, আসত আমাদের এধারে। দুজনে খেতে খেতে হাঁটতাম, আর হাঁটতে হাঁটতে খেতাম। আসবার সময় হাত ধরাধরি করে ফিরতাম আমরা।
সেদিন রিনি ফেরার কালে আমার হাত না ধরে আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে এল– ঠিক ছেলেদের মতই। ছেলেবন্ধুরা যেমন পাশাপাশি গলা জড়িয়ে যায় সেইরকই প্রায়। সত্যি বলতে এই জর্জর অবস্থাটা একটু কেমন কেমন ঠেকলেও তেমন আমার খুব মন্দ লাগছিল না।
রিনির মধ্যে ছেলেমানুষি তো ছিলই, ছেলেদের মতও খানিকটা যেন ছিল কীরকম। একাধারে ছেলে আর মেয়ে–এই কারণেই তাকে আমার ভালো লাগত আরো।
ওর চেহারাটাও ছিল যেমন ছেলে-ছেলে, ওর অনেক আচরণেও তেমনি ছেলেমি প্রকাশ পেত। ছেলেদের মেয়েলিপনা অসহনীয় বোধ হলেও মেয়েদের মধ্যে এই ছেলে ছেলে ভাবটা আনকোরা এক আকর্যণ মনে হয়।
ছেলেদের সঙ্গে ছেলেরা যেমন সহজে মেশে, রিনির সঙ্গে তেমনি অবলীলায় আমি মিশতে পারতাম। কোন কুণ্ঠা সঙ্কোচ ছিল না কোথাও।
সেদিন সারাটা পথ তার অকুণ্ঠ এই গলা জড়িয়ে আসাটা আকণ্ঠ আমার যেন অমৃতে ভরে দিল… মধু ঝরতে ঝরতে এল সারাক্ষণ। এমন কি, বাড়ি ফিরেও অনেকক্ষণ খালি কাঁধটাই আমার কাছে কালাকাদের মতন মিঠে ঠেকতে লাগলো।
বেড়িয়ে ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যে হয়ে যেত, তাই সোজা সে তার বাড়িতে চলে যেত আর আমি উপরে উঠে আসতাম।
সেদিন সে নিজের এলাকায় না গিয়ে আমার সঙ্গে উপরে এল।
তোমার পড়ার ঘরটা দেখব।
পড়ার ঘর বলে আলাদা কিছু নেই আমার। কয়েকটা বড় বড় হল তো। ঘর কোথায় আমাদের? ঘর আছে তোমাদের দিকটায়। ছোটখাট বেশ কয়েকখানা ঘর।
তাহলে তুমি পড়ো কোথায়?
শোবার ঘরেই পড়ি, আবার কোথায়? বাবার টেবিলে প্রকাণ্ড আয়নাটার সামনে গোল একটা কেদারা আছে, বেশ বড়ো কিন্তু বেজায় সেকেলে, সেইটেয় বসে টেবিলে বইপত্তর রেখে পড়াশুনা করি। দেখবে ল।
টেবিলের সামনে একটিমাত্র বড় কেদারায় আমরা ঘেষাঘেষি বসলাম। সে আমার বইখাতা হটকাতে লাগল।
ওমা! একী! কী লিখে রেখেছ সব?
কী লিখেছি! ওর সবিস্ময় শব্দে আমি সচকিত হই।
খাতা ভর্তি যা-তা কী লিখেছ সব? এ কী!
কী জানি। উদাসীনের মত বলি : হাতে কোনো কাজ থাকে না তখন কী করি, যা মনে আসে তাই লিখি।
তাই বলে পাতার পর পাতা জুড়ে খালি রিনি রিনি রিনি রিনি! এ কী! আমার নাম কেন? সে অবাক হয়। এত এত আমার নাম। কেন গো?
কে জানে কেন!
বারে! আর কী কোনো নাম ছিল না পৃথিবীতে? ঠাকুর দেবতার নাম লিখতে হয়। বাবা রোজ সকালে একপাতা করে দুর্গা নাম লেখেন। মা দুর্গার নাম। শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়, শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়। তার মানে বোঝা যায়। তোমার এ কী?
আমি তার কী জবাব দেবো? চুপ করে থাকি।
এ রকম লিখো না আর। কারো চোখে পড়লে কী ভাববে বল তো?
কী ভাববে আবার? ভাববার কী আছে!
ক্ষ্যাপা ভাববে তোমাকে।
এক মাঘে যেমন শীত যায় না, তেমনি এক ক্ষেপেও মানুষ পাগল হয় না কিন্তু তার কথার ঠিক জবাবটি আমি জানতুম কি তখন! খানিক চুপ থেকে বলি-ভাবুক গে। আমার বয়ে গেল।
সে আর কিছু বলে না।
কেন, তুই কি রাগ করলি আমার ওপর? আমি শুধাই : কালী দুর্গা না লিখে তোর নাম লিখে রেখেছি বলে?
সে কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে।
একটা অদ্ভুত নীরবতা যেন দেখা দেয় অকস্মাৎ।
অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে আমি স্তব্ধতাটা ভাঙি-দেখি তত তোমার ইংরেজী হাতের লেখা কেমন? লেখোত।
আমার খাতায় আমারই কপিং পেনসিলটা দিয়ে সে লেখে-ইউ আর এ ভেরী গুড বয়।
বাংলা লেখা দেখি এবার।
আমি তোমাকে ভালবাসি।
গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দেয়।
লিখে সে তার বড় বড় চোখ মেলে তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকিয়ে থাকি।
চুপ করে তাকিয়ে থাকি পরস্পর অনেকক্ষণ।
আমার কপিং পেনসিলটা তার মুঠোর মধ্যে তখনো।
আমার পেনসিলটা তোকে প্রেজেন্ট দিলাম। ফর এভার।
সে কিছু না বলে পেনসিলটা মুঠোয় করে চলে গেল তারপরে।
একদিন বিকেলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার দেখা না পেয়ে তার বাড়িতে তাকে ডাকতে গেছি। দেখি তার মা তখন প্রকাণ্ড একখানা ভোয়ালেয় দেহ জড়িয়ে কুয়ো তলায় বিকেলের গা ঘোয়ায় লেগেছেন।