রত্নহার আমার মাথায় থাক। ও নিয়ে আমি কী করব? আমায় দিবি। পরব আমি আমার গলায়। আমায় দিবি রে!
না বাবা।
সেখান থেকে ফিরে সেদিনকার রাণী ভূতেশ্বরীর সঙ্গে মোলাকাতের কথা মাকে বললাম। মা শুনে ভারী রাগ করলেন। কড়ে আঙুলটা কামড়ে দিলেন আমার। মনে মনে কী যেন আউড়ে সারা গায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
জানো মা, রাণী আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছিলেন। জানো মা, নানু বলছিল, ওর গলার হারটা দেবার জন্যই ডাকছিল আমাকে। আমরা নাকি ওর নিকটাত্মীয় হই?
খবরদার, ওই সব পোড়া বাড়ির দিকে পা বাড়াবিনে কোনদিন। পুনঃ পুনঃ মা সাবধান করে দিলেন আমায়।
সেদিন রাত্তিরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটেছিল নাকি! মার মুখে শুনেছি।
রাত নটার মধ্যেই খাওদাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়তাম আমরা। মার রান্নার কোনো ঘনঘটা ছিল না। লুচি, আলুর তরকারি, আর ক্ষীর–এই ছিল রাত্রের খাবার। বাবা খেতেন অনেক রাত্তিরে–তাঁর জপধ্যান সব সেরে। তাঁর খাবার ঢাকা দেওয়া থাকত গোলঘরটায়।
শুতে না শুতেই সেদিন হাড় কাঁপিয়ে আমার জ্বর এসেছিল নাকি।
দেখতে না দেখতে সে জ্বর চড়ে গিয়েছিল বেজায়। রাত দুপুরে ঘোর বিকারে দাঁড়িয়ে গেল। সান্নিপাতিক সব লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগল তখন।
আর, সেই সময়েই শুরু হয়েছিল দারুণ ভুতুড়ে উপদ্রব। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে যে রকম বর্ণনা রয়েছে–হুম হাম দুম দাম্ অট্ট অট্ট হাসিছে। অবিকল সেই ধরনের সব।
আর, মা আমার পাশটিতে শুয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে মা কালীকে ডাকছেন।
ওকে ছেড়ে দে, ওকে ছেড়ে দে। ওকে আমি নিয়ে যাব। খোনা গলায় বলেছিল কে যেন।
না মা, তোমায় গড় করি। ওকে তুমি নিয়ো না। ওকে ছেড়ে দিয়ে যাও, তোমার দোহাই! মিনতি করছিলেন মা।
না। তা হয় না। ও আমাকে ভেংচি কেটেছে কেন? ছাড়ব না, ওকে নিয়ে যাবই। নিয়ে যেতেই আমি এসেছি। তুই ছেড়ে দে।
মা, তোমার পায়ে পড়ি। তোমাদের বাড়ির বউ আমি। ওর হয়ে আমি মাপ চাইছি–তবধ বালক, ওকে মাপ করো। এবারটির মত ছেড়ে দাও। ওর ঘাট হয়েছে মা।
ওকে না নিয়ে আমি যাব না। আজ রাত না পোয়াতেই নেব।
তখন মা কী করেন, আর কোনো উপায় না দেখে কালীঘাটের মা কালীর কাছে তাঁর ডান হাত বাঁধা রাখলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভূতুড়ে উৎপাত শান্ত হল, আমার জ্বর ছেড়ে গেল, সকাল বেলা যেন দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম। সম্পূর্ণ বহালতবিয়তে।
রাতে যে আমাকে নিয়ে অত টানাপোড়েন চলেছিল তার বিন্দুমাত্রও আমি টের পাইনি। টের পেলাম সেদিন দুপুরে খেতে বসে।
আমি, মা আর আমার ভাই সত্য একসঙ্গে খেতে বসতাম সকাল সকাল। স্নান আহ্নিক সেরে বাবার খেতে বসতে দুপুর গড়িয়ে যেত।
মা বসেছেন আমার সামনেই। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি অবাক হয়ে শুধিয়েছি মা, তুমি ডান হাতে না খেয়ে বাঁ হাতে ভাত খাচ্ছ কেন আজ?
যেই না বলা, অমনি মা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।
সেদিন আর মার খাওয়াই হল না। সারাদিনটা উপোস গেল। খেলেন সেই রাত্তিরে। ভাত আর মার পেটে পড়ল না সেদিন।
তখন জানলাম রাত্তিরের ব্যাপারটা। মার ডান হাত বাঁধা রাখার কথা। মা এখন থেকে বরাবর বাঁ হাতেই খাবেন-যদ্দিন না সেই কালীঘাটে গিয়ে মার মানতের পুজো দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। মার খাওয়া পণ্ড প্রথম আমার থেকেই হয়েছিল। অনেকদিন তিনি অমনি উপোস করে কাটিয়েছেন।
প্রথম পাণ্ডা আমি হলেও তার পরে আরো অনেকের হাতেই তাঁর খাওয়া পণ্ড হয়েছিল। শেষটায় পাড়াপড়শীরা কেউ এলে খেতেই বসতেন না মা। বাঁ হাতে খাওয়া দেখলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগত তাদের মনে, আর তার জবাবে সেদিনকার সে বেলার মতন খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত মার।
তারপর থেকে সাবধান হয়ে গেছেন মা। বাড়ির অতিথি-অভ্যাগতরা নিজ গুণে বিদায় না নেওয়া পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন তিনি। খেতেই বসতেন না। অনেকদিন পরে কলকাতায় এসে কালীঘাটে পুজো দিয়ে তারপর হাত খালাস করতে পেরেছিলেন মা।
মা ডান হাতে খাচ্ছেন, তখন সে আবার আমাদের কাছে আরেক অবাক করা দৃশ্য।…
একটা রহস্যের আজও আমি ঠিক থই পাইনি। মার সেই দিব্যদর্শন আর আমার ওই অত দেখাটার।
মনের ইচ্ছাপূরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়ত বা তার কিছু হদিশ মেলে। যেরকমটা স্বপ্নে দেখে থাকি, সেইরূপ চোখ মেলেও স্বপ্ন দেখা যায়-অবচেতনের প্রার্থিত বস্তু হাতে হাতে পেয়ে যাই তখন।
মনই তো বাঞ্ছা কল্পতরু-বাঞ্ছিত বস্তু মিলিয়ে দেয় আমাদের। সব কিছুর তত্ত্ব মনের গুহাতেই নিহিত। মনের গুণেই ধন মেলে, কখনো বা কল্পনার কল্পলোকে। কখনো অকল্পনীয় ভাবে জীবনের এই বাস্তবে।
মা রাতদিন মা কালীর কথাই ভাবতেন তো! তারপর দরদালানে জবা ফুলটা দেখে তার অনুষঙ্গে তাঁর ভাবনা ঐ ভাবমূর্তি ধারণ করেছিল। এক রকমের আত্ম-সম্মোহন আর কি!
আর আমার ব্যাপারটাও প্রায় তাই। ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতে ভূতপেত্নীর দর্শন মিলেই থাকে, লোকমুখে শুনে শুনে গল্পগাথায় পড়ে জানা। তাই সালঙ্কারা ভূতেশ্বরীকে দেখেছিলাম। কিন্তু রাত্তিরে সেই হঠাৎ জ্বর বিকার হওয়া আর মার মানত করার সাথে সাথেই তার বেপাত্তা হয়ে যাওয়া–এর মানে? এই জিজ্ঞাসার জবাব পাইনে।
অবশ্যি, শেষ পর্যন্ত মহামতি শেপীরের মত তাবৎ প্রশ্ন ভূয়োদশী উক্ত হোরেশিয়োর ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় বইকি!