আর অষ্টম, বাড়তি খাটখানা ছিল মামা-টামা বা সম্পর্কিত দিদি-টিদি কেউ কখনো সখনো এলে-টেলে তার জন্যে।
রঙমহল শীসমহল ইত্যাদির মানে কী, আমার জানা নেই। মুঘল যুগের ইতিহাসে যাঁদের দখল আছে তারা বলতে পারেন। আমার মোগলাই অভিজ্ঞতার দৌড় ঐ পরোটা পর্যন্ত। আমার মনে হয় ওখানে বসে রাণী আর বেগমরা হয়ত মুখে হাতে নখে মেহেদির রঙ লাগানে আর রাজা কি রাজকুমাররা শীস দিয়ে ইশারা করতেন তাঁদের কিংবা সাড়া দিতেন তাঁদের ইশারায়। আর, তোষাখানাটা আমার ধারণায় ছিল খোসামোদের আখড়া। মোসাহেবদের তোষামোদে রাজাবাহাদুর এখানে আমোদিত হতেন, আমোদ পেত সভাসজ্জন সবাই।
গোলঘরটার উত্তর দিকে আরো অনেক ঘর ছিল, সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ খাড়া ছিল তখন। তারই ভেতর যে দু-একখানা তখনো পড়ে যায়নি তারই একটাতে ছিল আমাদের ভাঁড়ার ঘর আর তার পাশেই রান্নাঘর।
ঐ পর্যন্তই আমাদের এলাকা। তার ওধারটায় সাবেক মহাফেজখানা ছিল যেটা সেখানে থাকতেন এক ডাক্তার, সপরিবারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। রাজ এস্টেটের দাঁতব্য চিকিৎসার ভার ছিল তার ওপর।
কলকাতা থেকে এসেছিলেন তাঁরা। আমার মাও শহুরে মেয়ে। তাই দুই বাড়ির গিন্নীর ভেতর ভাব জমাতে বেশি দেরি হয়নি। আমার বাবা প্রথম পরিচয়েই ডাক্তারবাবুর বৌকে একটা হীরের আংটি উপহার দিয়েছিলেন আমার মনে আছে। কিন্তু সেহেতু মার কোনো রাগ হতে আমি দেখিনি।
ডাক্তারবাবুর ছিল চার মেয়ে আর এক ছেলে। কী যেন তাদের নাম। শুধু একজনের নাম এখনো আমার মনে আছে, সব্বার ছোট, সেই রিনি। প্রায় আমার বয়সী, দশ-বাবোর মধ্যে সবাই, তবে ছেলেটা আমার চেয়ে একটু বড়ই হবে বোধ করি।
আমার বেশ মনে আছে, আমরা দুই ভাই রাম লক্ষ্মণ সাজতাম আর সেই ছেলেটা-কী যেন ছিল তার নাম, সে হতো রাবণ। মোড়ার কাঠি ভেঙে তীর ধনুক বানিয়ে ঘোরতর যুদ্ধ হত আমাদের–যেটাকে ন্যায়যুদ্ধ বলা যায় না কিছুতেই। কেন না রাবণ হারতে চাইত কোনমতেই, সব শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে গায়ের জোরে হারিয়ে দিতে আমাদের। তীর ধনুক সব ফেলে দিয়ে পিটাতে এমন শুরু করত আমাকে-স্বভাবত রাবণের রামের প্রতি আক্রোশ বেশি হবার কথা–অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু আমারই পাশ-বালিশ বাগিয়ে দুমদাম লাগানোটা কি ঠিক? যতই বলি যে গদাযুদ্ধ রাবণোচিত নয়, দুর্যোধনের শোভা পায়, সেকথায় কান না দিয়ে সে বালিশ আর আমাকে একসঙ্গে ফাঁসিয়ে দিত। চোখে নাকে মুখে তুলো ঢুকে হাঁচতে হাঁচতে পালাবার পথ পেতাম না আমি। সে তখন লক্ষ্মণের সঙ্গে সন্ধি করে মার্বেল খেলতে বসে যেত বারান্দায়।
নীচের ডাক্তারখানা থেকে আমি একবার একটা কাঁচের পিচকিরি চুরি করে এনেছিলাম, বিশেষ কোনো কারণে না, এমনিই। ভালো লেগেছিল তাই। তাই না দেখে ভারী রাগ করেছিলেন বাবা, কাঁদতে কাঁদতে সেই পিচকিরিটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছিল আমায়। কম্পাউন্ডারবাবু পিচকিরিটা নিয়ে সিরাপ খাইয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন আমাকে, মনে পড়ে এখনও।
তোষাখানা আর মহাফেজখানা মাথা উঁচু করে থাকলেও পশ্চিম আর দক্ষিণের মালখানা আর বালাখানার সবটাই প্রায় পড়ে গেছল। এই চারখানার মাঝখানে অনেকখানি শান বাঁধানো ফাঁকা জায়গা ছিল–সেই বিরাট চত্বরে ম্যাজিক বা যাত্রার আসর জমত, পাঁচখানা পাড়ার লোক জড়ো হতো দেখতে। আর সেই চৌহদ্দিতেই ওরা পাঁচ ভাইবোন আর আমরা দুই ভাই মিলে বাতাবি নেবুর বল পিটিয়ে খুব ফুটবল খেলতুম।
আমাকে সঙ্গী করে বড়ো মেয়েটা, নানু বুঝি ছিল তার নাম, মাঝে মাঝে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরুতো। মেয়েটা ছিল দারুণ ডানপিটে। গায়ে জোরও ছিল বেশ। তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পারতুম না আমি কখনোই।– রত্নহারের সন্ধানে বেরুতাম আমরা একেকদিন। মহারাণীর রত্নহার। চারধারেই তো প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সে বলত এরই আনাচে কানাচে কোথাও না কোথাও মোহরের ঘড়ার সন্ধান পাওয়া যাবে। সেকালে তো ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক ছিল না। ধনরত্ন সব মাটির তলাতেই লুকিয়ে রাখত সবাই।
আমাদের বাড়িটার পশ্চিম দিকে রাণী ভূতেশ্বরীর অন্দর মহলের ভগ্নাবশেষে হানা দিতাম, যদি মহারাণীর হীরে মাণিক্যের খোঁজ মিলে যায় দৈবাৎ।
একদিন এঘরে সেঘরে ঘুরতে হঠাৎ একটা সুড়ঙ্গের মতন দেখা গেল। নানু বলল, আয় নেমে যাই, এর ভেতরটায় কী আছে দেখে আসি।
বাবা। আমি ঘাড় নাড়লাম। সাপখোপ থাকতে পারে। কামড়ে দেবে। বাবার কাছে সাপের ওষুধ আছে। সে বলল। ডাক্তারের মেয়ে, সাপের ভয় রাখে না সে।
তেমন তেমন সাপে কামড়ালে টের পাবি তখন। তোর বাবা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবি না। ঢুলে পড়বি এখানেই।
বয়ে নিয়ে যাবি তুই।
আমি? আমি তোকে তুলতে পারি? এখুনি পরীক্ষা করে দেখা যায়না বাবা। তুই যা ভারী। সুড়ঙ্গে সেঁধিয়ে কাজ নেই। এমন সময় সাজগোজ করা একটা মেয়ে থামের আড়াল থেকে ইশারা করল আমাদের।
থমকে দাঁড়ালাম আমরা। এখানে মেয়ে এলো কোথা থেকে রে? আমি নানুর কানে ফিসফিস করি।
রাণী ভূতেশ্বরী হবে বোধহয়। তোকে ডাকছে। হ্যাঁ তোকেই। যা না।
বাবা। গুপ্তধনের সন্ধান পেতে পারিস। বা মোহরের ঘড়ার খবর। যা না রে। ভয় কীসের! আমি তো রয়েছি এখানে?
না বাবা।
গলার হারখানা দেখেছিস? হীরে মুক্তো ঝকমক করছে। রত্নহারটা তোকে দিতে পারে–চাস যদি। চা না গিয়ে।