কাজী কি?
Kazi knows rule!
কাজীর কথা থাক, আপনার বাবার কথা কই…তিনিও কিছু কম কাজের কাজী ছিলেন না।
বাবার কুলকুষ্ঠী আর আপনার কাছে কী শুনব? তাঁর কুলকাহিনীর আমিও কিছু কিছু জানি। তাঁর মুখেই শোনা। বলব আপনাকে?
বলুন বলুন।
আমাদের আদি নিবাস ছিল নাকি চোঁয়ায়…মুর্শিদাবাদের কোনখানে যেন সেই জায়গাটা। সেখান থেকে চুঁইয়েই আমরা ওই চাঁচোরে গিয়ে পড়েছিলাম–তারপর সেখান থেকে বিদূরিত হয়ে কোথায় না। যাক, ওই চোঁয়া যে কেমন জায়গা চোখে দেখিনি যাইনি কখনো সেখানে, তবে বাবা একটা ছড়া কাটতেন–ছড়াটা তাঁরই কিনা কে জানে-শীত নেই গ্রিন্থি নেই সব সময়েই ধোঁয়া। সকাল নেই সন্ধ্যে নেই শেয়াল ডাকে হোয়া। গ্রামের নামটি চোঁয়া। এই চোঁয়ায় একবার এক যাত্রা পালার আসর বসেছিল। চাঁচোরেও আমি যাত্রাদল আসতে দেখেছি। মুকুন্দ দাসও এসেছিলেন একবার মনে আছে আমার। এখন চোঁয়ার কথাটাই বলি। যেদিন রাত্রে যাত্রা হবার কথা, সেদিন সকালে বাবা সামনের বাগানে প্রাতঃকৃত্য করতে গেছেন, দেশগাঁয় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে প্রকৃত রসিকের ন্যায় নিঃসর্গ দৃশ্য দেখতে দেখতে মুক্ত বাতাসে নিজেকে বিমুক্ত করাই যে রেওয়াজ তা আপনি অবহিত আছেন আশা করি। এখন, সেই যাত্রাদলের একটি ছোকরাও বসেছিল প্রাক্তকৃত করতে কাছাকাছি–তিনি লক্ষ্য করেননি। এহেন কালে একটা কুল এসে পড়ল তাঁর সম্মুখে। টোপাকুল। দেখে তিনি লোভ সামলাতে না পেরে মুখে পুরে দিয়েছেন, আমাই বাবা তো! কিন্তু সেই ছেলেটা সেটা দেখেছিল।…
তারপর?
তারপর, সন্ধ্যেয় যাত্রার আসর বসতে রাধাকৃষ্ণের পালা শুরু হোলো। সেই প্রাতঃকৃত্যের ছোঁড়াটা জটিলা-কুটিলার একজন সেজেছিল। নাচতে নাচতে আসরে এসে গাইতে লাগল, তোমার কুলের কথা কয়ে দেব, রাধার কাছেই হাত মুখ নেড়ে গাইছিল সে, তারপর গোটা আসরেই ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগল তাই। বাবার কাছে এসে যখন সে হাত নাড়তে লেগেছে–তোমার কুলের কথা কয়ে দেব–বাবা তাকে একটা টাকা প্যালা দিয়েছেন। চলে গেছে। এক চকর ঘুরে ফের সে ফিরে এসে শুরু করেছে, তোমার কুলের কথা কয়ে দেব। অমনি বাবা হাটে হাঁড়ি ভাঙবার ভয়ে পাঁচ টাকা প্যালা দিয়েছেন। ফের আবার। বকশিশ পেয়ে পেয়ে ছোঁড়াটার উৎসাহ বেড়েছে, ঘুরে ঘুরেই আসছিল সে আর গাইছিল ওই কুলের কথার কলিটা-বাবার মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে। আর বাবাও অমনি তেড়ে তেড়ে প্যালা দিচ্ছিলেন ছেলেটাকে তার মুখ চাপা দেবার জন্য। তিনি যত চাপতে চাচ্ছিলেন ততই তার চাপল্য বাড়ছিল যেন। সে ভেবেছিল তার গানটা বুঝি বেমায় মনে ধরেছে বাবুর–তাই সে গানও ছাড়ছিল না,, বাবাকেও না। মাছির মতই ভোঁ ভোঁ করছিল বাবার কাছে এসে। আর বাবাও পাগলের মত প্যালা দিয়ে যাচ্ছিলেন–ঐ করে বাবার আংটি গেল, সোনার ঘড়ি চেন গেল, গায়ের শাল দোশালা আংরাখা, লক্ষ্মেী টুপির কিছুই রইল না, সব চলে গেল বাবার ই গানের ঠ্যালা সামলাতে, কিন্তু প্যালারামকে থামানো গেল না কিছুতেই। শেষটায় কুলের কাঁটার যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে বাবা উঠে পড়লেন আসর থেকে–সর্বশেষে বাবা নিজের পরিধেয় বস্ত্রটি খুলে দিয়ে বললেন, যা ব্যাটা, কগে যা আমার কুলের কথা। হাগতে বসে একটা কুল খেয়েছি এই তো? কয়ে দিয়ে, বয়েই গেল আমর। বলে বিলকুল দিগম্বর হয়ে বেরিয়ে এলেন আসর থেকে।
তাই নাকি?
বাবার এই কুলকাহিনী তো আপনি শুনতে পাননি? সত্যি বলতে, সবার কুলকথা কুলকেচ্ছাই প্রায় এইরকম। আমিও নিজের কুলের কথা কাউকে কইতে চাইনে তো এইজন্যেই। পাছে দিগর সাজে লোকসম জে বেরিয়ে পড়তে হয় সেই ভয়।
.
০৬.
একেবারে পোড় বাড়ি ঠিক না হলেও প্রায় পড়ো পড়োই ছিল বটে বাড়িটা। আড়াই ধার তার পড়েই গেছল, দেড়টা দিক খাড়া ছিল কোনো গতিকে।
তাহলেও নামড়াকে রাজবাড়ি। পুরাতন রাজবাটী। চাঁচোরের রাজা ঈশ্বরচন্দ্র একদা মহাসমারোহে বাস করলে সেই প্রাসাদে।
বিরাট চার মহলা লম্বা চওড়া ছিল যে বাড়িটা তা তার চারধারের ধ্বংসাবশেষ দেখলেই বোঝা যায়। অন্দর মহল, রাণীরা থাকতেন যে ধারটায়, পশ্চিমদিকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে। দক্ষিণ ধারটাও ভাঙাচোরা চেহারা, তার একটা দিকের খানকয় পরিত্যক্ত ঘর তো আমার চোখের ওপরই ভেঙে পড়ল একদিন।
একশ বছরের ওপর নাকি বাড়িটার বয়স, তখন সেই পড়ন্ত অবস্থায় মনে হতো পড়তে পড়তে পুরোপুরি যেতে আরও একশ বছর লেগে যাবে বাড়িটার। সেকেলে শক্ত গাঁথুনির পোক্ত বাড়ি তো রীতিমতন বনেদী।
দোতলা বাড়ি। আমরা থাকতাম রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের সাবেক তোষাখানায়। পূর্বদিকের এলাকায়। তার বাঁ দিক ঘেষে স্নান করার গোসলঘর। এখন সংক্ষিপ্ত হয়ে গোর, সেটা পেরিয়ে গেলে শীসমহল ইত্যাদি-হলগুলো থাকলেও সে-সবের রঙ-চঙের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিল না আর।
দস্তুর মতন প্রশস্ত তোষাখানার ঘরটায় পর পর আটখানা খাট আটত। সেটাই ছিল আমাদের শোবার ঘর। বাবার নিজের ছিল তিনখানা খাট, যখন যেটাতে খুশি তাঁর দেহভার রাখতেন, তার ভেতরে একটা ছিল আবার পেল্লায়। আমার নিজের দখলে ছিল একখানা, বায়না করে বাগানো, আর আমার ভাই আর মার খাট দুখানা জুড়ে এক-করা, একটা বড় মশারির বিছানা ছিল সেই খাটে। আমি নিজের খাটে তো শুতামই, আবার ইচ্ছে হলে, ইচ্ছেটা প্রায়ই হত আমার, পাশের সেই জোড়া খাটে গিয়ে মধ্যিখানে সেঁধিয়ে পড়তাম এক এক সময়। বাবার পাশেও গিয়ে শুতাম কখনো-সখনো।