তবে শুনুন সেটা আমার কাছে। আপনার ঠাকুর্দার নাম হচ্ছে নবকুমার। ঈশ্বর নবকুমার চক্রবর্তী। সেই নবকুমারের পৌত্র আপনি, বুঝেছেন?
য্যাঁ? তাই নাকি? আমি যেন চোট সামলাই, তাহলে ইনিই কি সেই নবকুমার যিনি নৌকা থেকে কাঠ কুড়োতে নেমে বালিয়াড়িতে গিয়ে পথ হারিয়েছিলেন?
পথ হারিয়েছিলেন? তার মানে?
মানে, পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ-র নবকুমার? আপনি কি বলতে চান যে কপালকুণ্ডলা আমার ঠাকুমা? আমার বঙ্কিমকটাক্ষ।–বঙ্কিমবাবুর সেই মানস কন্যা যাকে দামোদরের বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে, কপালকুণ্ডলা ডুবিয়া গেল আর উঠিল না, বলে এক কথায় তিনি খতম করে দিয়েছিলেন, যে নাকি আবার সাঁতরে দামোদর পেরিয়ে মৃন্ময়ীরূপে লোকসমাজে ফিরে দেখা দিয়েছিল আবার?
আপনার ঠাকুমার নাম আমি পাইনি। চেষ্টাও করিনি জানবার। তবে আপনার জন্মবৃত্তান্ত জেনে এসেছি, তাও কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়।
হাতী ঘোড়া কিছু নয় নিশ্চয়? আর সবাই, সাধারণ মানুষেরা যেমন করে জন্মায়…
হাতী ঘোড়ার কথা আসছে কেন এখানে?
মানে, আমার জন্ম ব্যাপারে হাতীমার্কা কিছু ঘটেনি, সেই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম। গোপা দেবী গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে হাতীর স্বপ্ন দেখেছিলেন না?
না, তেমন অলৌকিক কিছু না হলেও একেবারে লৌকিকও বলা যায় না ঠিক। মার মুখে আপনি শোনেননি কিছু?
শুনেছিলাম একটুখানি এক সময়। কিছুতেই নাকি আমি হচ্ছিলাম না, তাই বাবা-মা বিন্ধ্যাচলে গিয়ে মানত করেছিলেন ছেলের জন্যে–আর তারপরেই নাকি আমি হলাম। মা বিন্ধ্যবাসিনীর দয়াতেই হওয়া, জগন্মাতার দোয়াতেই আমার পাওয়া। তাই মা আমার নাম রেখেছিলেন পার্বতীচরণ। পরে বাবা আমার সেই প্রথম নামটা পালটে শিবরাম বানিয়ে দেন।
কেমন করে পাওয়া আপনি, জানেন তো? তাঁরা দেবীর পূজো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পান এক নবজাতক শুয়ে রয়েছে মন্দিরচত্বরে, অনেক খোঁজখবর করেও তার বাপ-মার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সেই বেওয়ারিশ শিশুটিকেই মার দেওয়া মনে করে তুলে নিয়ে এসে তাঁরা মানুষ করেন। সেই শিশুই হলেন আপনি।
আশ্চর্য নয়। আমারও সেইরকম মনে হয়। বলেছিলাম না আপনাকে যে আমি কোনো বস্তির আমদানি, নয়ত রাস্তার কোণ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া–মিলে গেল তো?
মেলালেই মেলে। তিনি নিশ্বাস ফেলেন।
তিনিই মেলান। মেলাবার মালিক তিনিই। মেলাবেন তিনি মেলাবেন-অমিয় চক্কোত্তির সেই কবিতাটা স্মরণ করুন। বস্তির সঙ্গে শ্রাবস্তির, কুঁড়ে ঘরের সঙ্গে কুঁড়ের বাদশাকে তিনিই মিলিয়ে দেন–মিলিয়ে থাকেন। সবই তাঁর অবদান।
এবার আপনার বাবার চরিত্রকথা শুনুন তবে– যা জেনে এসেছি। আপনার মনঃপূত হবে কিনা জানি না। আপনি তো বললেন–আমার বাবা পূত চরিত্রের দেবতুল্য আত্মভোলা মানুষ ছিলেন–কিন্তু সুন্দরী ললনাদের প্রতি দারুণ তাঁর ঝোঁক ছিল জানেন সেটা?
নিজের থেকেই জানা যায়-আমার মধ্যেও সেই ঝোঁক যে। আমার দেহে বাবার রক্ত প্রবাহিত কি না জানি না, যদি আমি বিন্ধ্যাচলের সেই বেওয়ারিশ ছেলেই হই, তবে আমার স্নেহে সেটা প্রকট। বাবার দৃষ্টান্তেই মানুষ তো! নামান্তরে সেই বাবাই। সুন্দর মেয়েদের সামনে আমিও আপনাকে সামলাতে পারি না। কেউ পারে কি না কে জানে!
সুন্দরী বধূদের তিনি হীরে চুণী পান্নার আংটি উপহার দিতেন জানেন তা? সে তল্লাটের অনেক গিন্নীই হাতের সেই আংটি দেখালেন আমায়–প্রৌঢ় হলেও প্রথম যৌবনে যে তাঁরা রূপসী ছিলেন দেখলেই সেটা টের পাওয়া যায়। এটা আপনি জানতেন?
জানব না কেন। স্বচক্ষে দেখছি। যখনই তিনি কলকাতায় যেতেন একগাদা সোনার আংটি গড়িয়ে আনতে পাথর বসানো, আর যাঁকে তাঁর ভালো লাগত স্বহস্তে তার আঙ্গুলে। পরিয়ে দিতেন দেখেছি। …আর এটা…এটা অনেকটা তার পাণিগ্রহণের মতই যেন, আমার মনে হত সেই সময়।
আর আপনি এদিকে বলছেন আপনার বাবা ছিলেন নিরাসক্ত দেবতুল্য মানুষ–
তাতে কী হয়েছে! মহাদেবের কি মোহিনীর প্রতি ঝোঁক ছিল না? বাবার হয়ে সাফাই গাই : আর সত্যি বলতে, বাবার ওই আদর্শ থেকেই আমি প্রেরণা পাই। এটাকে মনের দুর্বলতা বলতে পারেন, কিন্তু আমার মনের জোর ওই থেকেই। নিজের মনের দুর্বলতা অনায়াসে কাটিয়ে ওঠার অতি সহজ এই উপায় বাবার দৃষ্টান্ত থেকেই আমি শিখেছি। বাবার ওই আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়–তাঁর ওই আচরণের ছেলেবেলাকার সেই-শিক্ষায় এই অধম জীব বহুৎ বাধা অবলীলায় উৎরে এসেছে।
পরস্ত্রীর প্রতি ওই আসক্তি কি ভালো?
তা আমি জানিনে। তবে বলতে পারি আমার মধ্যে একটুও পরস্ত্রীকাতরতা নেই। পরস্ত্রী ছাড়া কি আর মেয়ে নেই দুনিয়ায়? পরকুমারীরা সব গেল কোথায়? পরীর মত মেয়েরা?
তারা থাকতে-পরধনে হস্তক্ষেপ করবার দরকার! তবে হ্যাঁ, ওই আংটি দেওয়াটা একটু ব্যয়সাপেক্ষ বটে। কিন্তু ও ছাড়াও বিয়ে না করেও পরকন্যার করলাভের অন্য পথ আছে আরো, একেবারে নিখর্চায়। কাজী আমায় শিখিয়েছিল পামিস্ট্রি। মিষ্টি হাতকে হস্তগত করার সহজ উপায় হচ্ছে ঐ হাত দেখা। ঐ করে প্রথম হাতিয়ে না, তারপর শনৈঃ শনৈঃ! আর কী! শনৈঃ পন্থা শনৈঃ কস্থা-শনৈঃ পর্বত লঙ্নম ইত্যাদি! কাজী নাকি ঐভাবেই বাগাতে মেয়েদের। আর সেই কারণেই আমি বলতাম, আমাদের মধ্যে কাজী…কাজীই একমাত্র…