হেমাঙ্গিনী–কী বলছেন? আমার মার নাম যে শিবরাণী।…আমি প্রকাশ করি : বাবার নাম শিবপ্রসাদ। আমার ভাইয়ের নাম শিবসত্য, ঘাটশিলার স্কুল কাম কলেজের হেডমাষ্টার বনাম প্রিন্সিপাল। শিব দিয়ে মিলিয়ে নাম সব আমাদের।
শুনে তিনি অবাক হন–এরকম নামের যোগাযোগের মানে?
কে জানে, কেন! আমাদের দুভায়ের নাম বাবার রাখা–তিনিই মিলিয়ে রেখেছেন আর, মার নামটা নাকি হয়েই ছিল আগের থেকে। আর, ঐ নামের মিলের কারণেই বিয়েটা হল নাকি শুনেছি।
মনের মিল হয়ে বিয়ে হয় তা জানি, কিন্তু এই নামের মিল দেখে-আশ্চর্য তো!
আশ্চর্য তো বটেই। বাবা যখন সাধুবেশে মুক্তিলাভের আশায় হিমালয়ের পথে বিপথে ঘুছিলেন তখন এক ঋষিকল্প সন্ন্যাসী নাকি তাকে সংসারে ফিরে গিয়ে বংশরক্ষণ করে নিজের প্রাক্তনখণ্ডনের উপদেশ দেন, আর তিনিই বলেছিলেন যে, তাঁর উপযুক্ত সহধর্মিণী অপেক্ষা করছে–যার নাম লেই তিনি টের পাবেন। আর একটা রাজপ্রাসাদও নাকি তৈরি হয়ে রয়েছে তাঁর জন্যে। ভদ্রলোকের এই দুটো ভবিষ্যবাণীই কিছু কিছু ফলেছিল বাতে হয়।
সেই রাজপ্রাসাদটা আমি দেখে এসেছি এবার ওই চাঁচোরে গিয়ে, যেখানে আপনারা এককালে বাস করতেন। ওল্ড রাজ প্যালেস বলে থাকে লোকে এখনো। তবে তার রাজোচিত চেহারার কিছু আর অবশিষ্ট নেই…তিন বার পড়ে গেছে তার। অনেক- কাল হল তো।
আমার বাবা যখন সন্ন্যাস ছেড়ে সংসারে ফিরে এলেন তখন স্বভাবতই তাঁর বিয়ের কথা উঠল–নানা জায়গার থেকে সম্বন্ধ নিয়ে আসতে লাগল ঘটক। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম শিবরাণী দেখেই না, বাবা ঠিক করে ফেললেন, বললেন যে, ওই মেয়েই আমার সহধর্মিণী।
অবাক কাণ্ড তো?
সেই পরমহংসদেবের মতই না? তিনি ছোটবেলাতেই এক দঙ্গল বালিকার মধ্যে একটিকে দেখিয়ে বলেছিলেন–ই আমার বৌ। পরে তার সঙ্গেই তাঁর বিয়ের ঠিক হয়। তিনিই মা সারদামণি। তাই না?
তা না হয় হোলো কিন্তু বিলকুল গড়বড় হয়ে যাচছে যে! বিশ্বস্তসুত্রে পাওয়া খবর সব… জেনে এলাম আপনার মাকে খুন করে বাবা ফেরার হয়েছিলেন, এদিকে আপনি বলছেন বাবা মারা যাবার পরেও আপনি মাকে দেখেছেন। মনে হচ্ছে, যাকে দেখেছেন তিনি আপনার মা নন, সৎ মা। উক্ত হেমাঙ্গিনী দেবীই মা ছিলেন আপনার…আপনার বাবা দুই বিবাহ করেছিলেন, আপনি তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলে।
আবার আমার প্রতি আপনার এই অযথা পক্ষপাত…
অসম্ভব কিছু নয়ত। সেকালে একাধিক বিয়ের রেওয়াজ ছিল যে। প্রায় লোকেই তা করতেন।
জানি। তবে সেটা কুলীনদের বেলাতেই হতো মশাই! এক কুড়ি দুকুড়ি বিয়ে করা তাঁদের পক্ষে কিছুই ছিল না–এমনকি কুড়িয়ে বাড়িয়ে একশও ছাড়িয়ে যেত কারো কারো শুনেছি। কিন্তু চকরবরতিরা কুলীন নয়, যদ্দুর আমি জানি।
চকরবরতিরা কঞ্জুস হয় একথাটা যেমন আপনার জানা তেমনি তো? তিনি হাসতে থাকেন।
চকরবরতিরা যে কঞ্জুস হয় সেটা কেবল জানা নে, আমার দেখাও যে। আমি জানাই : এই চর্মচক্ষেই দেখা-আয়নার মধ্যে জাজ্বল্যমান।
তাহলেও, কুলীন না হলেও দুতিনটে বিয়ে এমন কিছু কঠিন ছিল না কারো পক্ষেই তখন এমন অন্নসংকট তো দেখা দেয়নি সে সময়। আমার ধারণা আপনার বাবা ফেরার দশার পর ফিরে এসে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন এই শিবরাণী দেবীকে।
তাহলে তো সেই দুর্লভ সৌভাগ্যলাভ হত আমার, যা খুব কম ছেলের বরাতেই ঘটে থাকে… আমি বলি : বাবার বিয়ে দেখতে পেতাম আমি। মানে এই দ্বিতীয় বিয়েটাই। আমার চোখের ওপরই ঘটত তো! আর কিছু না হোক, বৌভাতের দিন অন্তত পানের খিলি বিলি করার পাটটাও আমি পেতাম।
তার জন্যে আপসোস করবেন না। আপনার লেখায় তো তাই বিলিয়েছেন সারা-জীবন। বলে তিনি খিলখিলিয়ে হাসেন।
সে কথা সত্যি, মানতে হয় আমায়। পাঠক-পাঠিকার পাতে আর সব লেখকের নানান উপাদেয় ভুরিভোজ্য পরিবেশনের পর জীবনভোর আমার ঐ পানের খিলি বিলোনোই তো। পুষ্টিকর কিছু নয়, মুখ বদলাবার জন্য তুষ্টিকর হয়ত যৎকিঞ্চিৎ। আমার ফসলে ধান গমের কিছু নেই, তার আবাদেও পারঙ্গম নই আমি, ধার করা ধারালো আমার বরোজে খালি ওই পানই ফলে। চুটকি লেখার চটক! কারো মনের আকাশে খানিকক্ষণ উড়লেও খানিকবাদে ফুরুৎ করে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।
যাক। ওসব কথা থাক, আপনার কুলপঞ্জীতে আসি। আপনার কাছে খবরগুলো যাচিয়ে নেওয়া যাক। আপনার ঠাকুর্দার নামটা কী বলুন তো?
কি করে বলব! আমার বাবাই জানেন।
আপনি জানেন না? শোনেননি কখনো বাবার কাছে?
শুনব না কেন, কত বারই তো শুনেছি। কিন্তু বছরে একবার করে শুনলে কি মনে থাকে নাকি কারো, না মুখস্থ হয়?
বছরে একবার করে?
হ্যাঁ, সেই মহালয়ার দিন পার্বণশ্রাদ্ধর সময়। তখনই বাবা ঊর্ধ্বতন চোদ্দ পুরুষের নাম আউড়ে তর্পণ করতেন…সেই দেবশর্মণদের নাম তখন তখন হলে না-হয় বলতে পারতাম; কিন্তু এখন অ্যাদ্দিন বাদে
কিন্তু অন্তত তিন-চার পুরুষের নাম তো মনে থাকে, মনে রাখে সবাই।
রেখে লাভ মশাই? যখন সেই অতীত কুলকোটিনাম্ সপ্ত দ্বীপনিবাসিনীম কারো নামই আমাদের স্মরণে নেই, তখন হরানো মহাসমুদ্রের এক গণ্ডুষ মাত্র-গণ্ডাকয়েকের নাম মনে রেখে কী হবে? তবে… আমার আরো অনুযোগ–এটুকু আপনাকে বলতে পারি ঠাকুর্দার সম্পর্কে যে, শিব দিয়ে তাঁর নাম নয়। কেননা, আমার বাবা তো তাঁর নামকরণের সুযোগ পাননি আদৌ।