ব্ৰহ্মচৌর্য কী বলছেন? ব্রহ্মচর্য বলুন।
একই কথা। বাগর্থ এক হলেও তার বাচ্যার্থ ভাবার্থ গূঢ়ার্থ অনেক থাকে–নানা অর্থে তার, নানান অনর্থ। ব্রহ্মকে চর্যাপদে আনলে পদে পদে ঐ চৌর্যকমই। তাছাড়া পথ কই? বাঁচতে হলে, বাঁচার মত বাঁচতে হলে ব্ৰহ্মবৃত্তি আর চৌর্যবৃত্তি দুই-ই আমাদের চাই যে। পরম ব্রহ্মের সাক্ষাৎ অবতার স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নিজের জীবনে সেই দৃষ্টাত দেখিয়ে গেছেন। বাঁচার তাগিদে ননী চুরি থেকে গোপিনীর বস্ত্রহরণ কিছুই বাদ দেননি তিনি।
টাকা পয়সা চুরি করাটাকেই আমরা চুরি বলে ধরি, শ্রীকৃষ্ণ তা করেননি।
খাবার অভাবেই লোকে টাকা পয়সা চুরি করে–অভাব মেটাবার স্বাভাবিক তাগাদায়। ছেলেবেলায় চুরি করে থাকে সবাই-অভাববশত নয়, স্বভাবতই। তারা ওটা চুরি বলে মনে করে না। শ্রীকৃষ্ণও বাল্যকালে সেই need ছিল, ননী খাওয়ার লোভ; তার অভাব মেটাতেই ননী চুরি করে তাঁর ওই no-need হতে যাওয়া। কিন্তু খাবার কি তার বিকল্প টাকা পয়সা চুরি করাটাকে চুরি বলেই আমি মনে করি না। শুধু অর্থই নয়, পরমার্থও আমাদের চুরি করে পেতে হয়। সহজে মেলে না।
কিছুই সহজে মেলবার নয় তা জানি। সে কথা ঠিক। তিনি মেনে নেন।
পরকে একপ্লয়েট না করে বাঁচা যায় না। পরকে আত্মসাৎ করে, পরের আত্মসাৎ করেই আমরা বাঁচি, আমরা বাড়ি, আমরা হই। এই চুরি বিদ্যাই হচ্ছে বড় বিদ্যাসুন্দর বিদ্যা। তার সমন্বয়েই এই জীবন বিদ্যাসুন্দর। সেই চৌর পঞ্চাশৎ যেমন কালীপক্ষে তেমনি বিদ্যাপক্ষেও…আমার কথা যদি বলেন, আমি এতাবৎ বেঁচে রয়েছি পরের খেয়ে-পরেই। পরের এবং পরীর।
পরীর?
হ্যাঁ, পরীর তো অবশ্যই। পরের থেকে অর্থ, আর পরীর থেকে পরমার্থ-পেলেই না সর্বার্থসিদ্ধি? একপ্লয়েট এবং সেপ্লয়েট? দুয়ে দুয়ে যেমন চার, তেমনি দু হাতে দুধারের দুয়েই না আমাদের বাঁচার?
কী বলছেন মশাই?
সেই কথাই বলছি…কামিনী আর কাঞ্চন এই দুটিই আমাদের জীবনের সার বস্তু। জীবনের আর পৃথিবীর। এই দুই নিয়েই তো বাঁচা। বাঁচার মত বাঁচার জন্য দুইটাই চাই আমাদের যে করেই হোক। আর ভাবান? হ্যাঁ, ভগবানও বটে। তিনি এই উভয়ের মধ্যে উত্ত। দুই মেরুর মধ্যে দণ্ডের মতই গুহ্য তিনি, তাঁর ওপর ভর করে তাঁর ভরসাতেই পৃথিবীর মতন আমাদের সূর্য প্রদক্ষিণ। শিরদাঁড়া না থাকলে কি বাঁচা যায় মশাই? খাড়াই হওয়া যায় না। ঠিক মতন। তাই ভগবানও আমাদের চাই বই কি। দুই মেরুর মধ্যে একই প্রাণদণ্ডে আমাদের সঙ্গে তিনি সমান সজীব। সেই অক্ষর বস্তু আপন স্বরে আর আমার ব্যঞ্জনায়-সম্মিলিত হয়ে যুক্তাক্ষর-কামিনী আর কাঞ্চন নিয়ে সশরীরে আমাদের মধ্যেই। আপন মহিমার নব নব ভূমিকায়। অবতার রূপ না ধরেও আমরা প্রত্যেকেই তাঁর অবতারণা।
কিসের থেকে কিসের অবতারণা!
আজ্ঞে, সেই কথাই।…এই কামিনী আর কাঞ্চন…পরের থেকেই পেতে হয় আমাদের, পরস্বাপহরণ না করে মেলে না কখনোই। একআধটু চুরি-চামারি না করলে কেউ বাঁচতেই পারে না। এই দুনিয়ায় বোধ হয় বাঁচাই যায় না একদম। অন্তত আমি তো পারিনি মশাই। আমার কথা যদি কই, মার্কটোয়েনের থেকে চুরি করেই আমার হাসির লেখার হাতেখড়ি-আমি লেখক হই। শুধু তিনিই নন, আরো অনেকে কাছে আমি ধারি। মুক্তহস্তের সেই ধার মুক্তকণ্ঠে আমার স্বীকার। চার ধারের মতো আখের রস পেষণ করে আমার এই আখের। এই লেখক পেশা। চোরামির কৌশল মজ্জাগত ছিল বলেই ছ্যারাতে ছ্যাঁচরাতে আসতে পেরেছি অ্যাদ্দিন–জীবদ্দশায় টিকে থেকে কোনো গতিকে। সত্যি বললে, আমি যেমন চোর তেমনি এক ছ্যাঁচোর। সে কথা প্রকাশ করতে আমার কুণ্ঠা নেই।
অসম্ভব না। খুনের ছেলের পক্ষে চোর হওয়া বিচিত্র নয় কিছু।
কী বললেন?
আপনার বাবা যে রাজ্যলোভ সংবরণ করে বিবাগী হয়ে সন্ন্যাসী হতে গেছলেন, সে কোনো ঈশ্বরের খোঁজে নয় মশাই। আপনার মাকে খুন করে তিনি ফেরার হয়েছিলেন।…
.
০৫.
ওমা, সে কী কথা গো। শুনেই না আমি আৎকে উঠেছি : তা কি কখনো হয় নাকি!
হবার কী আছে? তিনি বললেন : সেকালের পতিদেবতারা সাধারণ মানুষ ছিলেন।, তাঁদের পক্ষে এ তো অতি সহজ কাজ। সেযুগে বৌ ঠেঙানো লোকে বিলাসিতা বলেই মনে করত, আর, বৌকে খুন করে ফেলা তো চরম বাহাদুরি। আপনার বাবা কিছু আর তখনকার সমাজবহির্ভূত লোক নন? তবে হ্যাঁ, এই ফেরার হওয়াটা একটু সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার বটে। স্বভাবতই সে সময়ে এসব আপনার থেকেই চাপা পড়ে যেত, থানার দারোগাকে কিছু ধরে দিলেই মিটে যেত হাঙ্গামা। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সদরের পুলিস সাহেবের কানে গিয়ে গড়িয়েছিল কিনা। তিনি স্বয়ং সরজমিনে তদন্তের জন্যে মহানন্দাপথে তাঁর বজরায় এসে পড়লেন একদিন…গেরেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে…
আর, বাবাও অমনি রাজ্যপাটের পরোয়া না করে আমাদের নদীতটে সায়েবের বজরাঘাতের আগেই কেটে পড়লেন সেখান থেকে। আমি অনুযোগ করি : এই তত বলতে চাইছেন আপনি?
অবিকল।
কিন্তু তা কি করে হয় মশাই? আমার মাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি যে…জলজ্যান্ত দেখেছি…বাবা মারা যাবার পরেও অনেকদিন তিনি বেঁচে বর্তে বহাল তবিয়তে ছিলেন।
তাই নাকি? কিন্তু আপনার মা হেমাঙ্গিনী দেবীর নিহত হবার খবর সেখানকার সুপ্রাচীন অনেকের কাছেই জেনে এলাম যে!