— যা আমানুদ্দৌলার কাছ থেইকা একটা ম্যাচ লইয়া আয় তো।
তইতই যেদিন গেল, সেদিনই মা ফরমাশ দেন আমাকে। মা জানেন কাকার কাছে দেশলাই আছে, তাঁকে সিগারেট ফুঁকতে দেখেছেন তিনি। আমার কাকার ঘরটি সেটি, যে ঘরে খড়ি থাকত, যে ঘরে মজার একটি জিনিস দেখাবেন বলে শরাফ মামা এক মরা বিকেলে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি কাকা শুয়ে আছেন চৌকিতে। কাকা দেখতে বাবার মত। কোঁকড়া চুল, খাড়া নাক, বড় বড় চোখ, ঘন কালো ভুরু, ফর্সা গায়ের রং। বাবাকে ইটের তলে চেপে খানিকটা চ্যাপ্টা করে মাথা চেপে লম্বায় খানিকটা খাটো করে দিলে আমান কাকাই দাঁড়াবে। ঘরটির চেহারা পুরো বদলে গেছে। খড়ি নেই, ইঁদুর নেই। টিনের বেড়ায় লাগানো একটি বাঁধানো ছবি, চুলে ঢেউ তোলা পায়ে পাম্পসু পরা কাকার ছবি। ছবির ডান পাশে মেয়েমানুষের মুখের ছবি অলা ক্যালেন্ডার। বেড়ায় গোঁজা আয়না, চিরুনি। আলনায় অভাঁজ কাপড় চোপড়।
–কাকা, মা ম্যাচ চাইছে। ক্যালেন্ডারের ছবি দেখতে দেখতে বলি।
–তুমার মা ম্যাচ দিয়া কি করব? বিছানা থেকে নেমে বুকের লোমে আঙুল ঘসতে ঘসতে আমান কাকা প্রশ্ন করেন।
বলি–চুলা ধরাইব। ভাত রানব।
কাকা বলেন–আমার কাছে ত ম্যাচ নাই।
দেশলাই নেই শুনে পা বাড়াই ঘরের বাইরে।
কাকা টেনে আমাকে ঢোকান ভেতরে। দাঁত মেলে হাসতে হাসতে বলেন –আরে খাড়ও, খাড়ও, ম্যাচ লইয়া যাও। ম্যাচ আছে।
যাদু দেখানোর মত হঠাৎ একটি দেশলাইএর বাক্স চোখের সামনে ধরেন আমার। হাত বাড়াতে গেলে তিনি সরিয়ে নেন হাত। আবার ধরতে যাই, আবার সরিয়ে নেন। এই ভেসে ওঠে চোখের সামনে দেশলাই, এই নেই। জোনাক পোকার মত, এই আলো, এই আঁধার। দেশলাই ধরতে কাছে যাই কাকার, কাকা টেনে আমাকে আরও কাছে নেন। আরও কাছে গেলে কাকা দেশলাই না দিয়ে পেটে বগলে কাতুকুতু দিতে দিতে আমাকে বিছানায় ফেলেন চিৎ করে। আমি কুঁকড়ে থাকি শামুকের মত। আমার শামুক শরীরটি কাকা শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দেন, কাকা ডাং, আর আমি যেন তাঁর ডাংএর গুটি। আমার শরীর বেয়ে কাকার হাত নেমে আসে আমার হাফপ্যান্টে, হাতটি নামাতে থাকে হাফপ্যান্ট নিচের দিকে। গড়াতে গড়াতে আমি বিছানা থেকে নেমে যেতে থাকি। আমার পা মেঝেয়, পিঠ বিছানায়, হাফপ্যান্ট হাঁটুর কাছে, হাঁটু বিছানাতেও নয়, মেঝেতেও নয়। গলায় আমার নাল শরিফের তাবিজ। কাকা তাঁর লুঙ্গি ওপরে তোলেন, দেখি কাকার তলপেটের তল থেকে মস্ত বড় এক সাপ ফণা তুলে আছে আমার দিকে যেন এক্ষুণি ছোবল দেবে। ভয়ে আমি সিঁটিয়ে থাকি, আমাকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে আমার দু’উরুর মাঝখানে ছোবল দিতে থাকে সেই সাপ। এক ছোবল দুই ছোবল তিন ছোবল।
ভয়ে আমার গা হাত পা কাঠ হয়ে থাকে। আমার বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে কাকা বলেন–লজেন্স খাইবা? তুমারে কালকা লজেন্স কিইনা দিমু। এই নেও ম্যাচ। আর শুন মামনি, কাউরে কইও না তুমি যে আমার নুনু দেখছ আর আমি যে তুমার সুনা দেখছি। এই সব খারাপ জিনিস, কাউরে কইতে হয় না।
আমি দেশলাই হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। দুউরুর মাঝখানে ব্যথা হয়, পেচ্ছাব পায়, আবার দেখি পেচ্ছাবে ভরে গেছে আমার হাফপ্যান্ট। জানি না কি নাম এই ন্যাংটো- খেলার। আমি বুঝে পাই না কি কারণে শরাফ মামা বা আমান কাকা আমার ওপর চড়ে বসেন। কাকা বলেছেন এসব কাউকে বলতে হয় না। আমারও তাই মনে হয়, এসব কাউকে বলতে নেই। সাত বছর বয়সে হঠাৎ এক বোধ জন্ম নেয় আমার ভেতর, যে, এসব বড় শরমের কাজ, এসব কথা কখনও কাউকে বলা ঠিক নয়, বড় গোপন ব্যাপার এসব।
কেন আমি বাড়ির কাউকে জানাইনি অমন দুটো ঘটনার কথা সে আজও ভাবি। মামা কাকাদের লোকে মন্দ বলুক আমি চাইনি বলে! সংসারে ওদের মান রক্ষা করার দায় কি কেউ আমাকে দিয়েছিল! যেহেতু ওরা আমার কাকা মামা, যেহেতু বাল্যশিক্ষায় পড়েছিলাম গুরুজনকে সর্বদা মান্য করিবে! যেহেতু ওঁদের আমি ভাল মানুষ বলে জানি, সেই জানাই যেন সত্য হয়! যেন যা ঘটে গেছে সেটি সত্য কোনও ঘটনা নয়, সর্বৈব মিথ্যে, আসলে সে আমারই দুঃস্বপ্ন, অথবা কাকা বা মামার রূপ ধরে ওরা অন্য কেউ, ছিল জন্মের শত্তুর কেউ! কে আমাকে বোবা করে রেখেছিল, গোপনে পুষতে বলেছিল সব যন্ত্রণা একা একা! বাড়ির সবাই আমার অভিযোগকে হাওয়ায় উড়িয়ে বলবে আমাকে জিনে ভূতে ধরেছে, অথবা আমি পাগল, অথবা আমি মিথ্যুক, আমি একটা পিঁচকে শয়তান, আমাকে কেউ কোলে নিয়ে চুমু খাবে না উল্টে চড় চাপড় লাগাবে এই ভয়ে বা দ্বিধায় কি মুখ খুলিনি! নাকি কাউকে আপন বলে আমার মনে হত না, যার কাছে মন খুলে কাঁদতে পারি, যার কাছে শুরু থেকে শেষ অবদি খুলে খুলে বলতে পারি, দেখাতে পারি ক্ষত, মা’কেও এমন আপন মনে হয়নি আমার যে মা’র আঁচলের তলে আমার জগত, যে মা একটি বৃক্ষের মত, যার ছায়ায় আমি প্রাণ জুড়োই, যে মা স্বচ্ছ জলের পুকুর, যার জল পান করে আমি বাঁচি, সেই মা’কেও যদি আপন মনে না হয় তবে আর কাকে হবে!
আমার ভেতরে তখন দু’জন আমি, এক আমি দল বেঁধে অপেনটো বায়োস্কোপ খেলি, গোল্লাছুট গোলাপপদ্ম খেলি। আরেক আমি উদাস বসে থাকি একা, পুকুর ঘাটে, রেললাইনের ধারে, ঘরের সিঁড়িতে। হাজার মানুষের কোলাহলে একা। একা এই মেয়ের সঙ্গে ক্রোশ ক্রোশ দরত্ব তৈরি হয় সবার। মেয়েটির হাত এই দূরত্ব ডিঙিয়ে কারুকে ছুঁতে পারে না, এমনকি মা’কেও নয়, হাত বাড়ালে হাতের ভেতর মুঠো মুঠো শূন্যতা জমা হয়।
০৬. পীরবাড়ি ১
উনসত্তরের শেষ দিকে আমাদের চলে আসতে হয় আকুয়ার পাট চুকিয়ে। এঁদো গলির ধারে খলসে মাছে ভরা পুকুর, তার পাশে, কড়ই নিম খেঁজুর আর সুপুরি গাছের বেড় দেওয়া নানির চৌচালা ঘর, উঠোনে কুয়ো ছাড়িয়ে নারকেল গাছের সার, তার ওপারে আরেক ফালি উঠোন, উঠোনের উত্তরে বৈঠক ঘর, দক্ষিণে শোবার, শোবার ঘরের সিঁড়ির কাছে পেশাবখানা, পশ্চিমে খাবার ঘর আবার আরেক ফালি উঠোন আরও পূবে, দাদাদের আর খড়ির ঘরের মাঝখানে, যে ঘর পরে কাকার ঘর হয়ে ওঠে, খড়ি রাখা হয় বৈঠকঘরের পাশে ঘুমটি ঘরের মত লাল একটি ঘরে–সব ফেলে আমরা, আমি, দাদা, ছোটদা, বাবা, মা, ইয়াসমিন উঠি এসে আমলাপাড়ায় বিশাল বাড়িতে। বাড়িতে বোতাম টিপলে বাতি জ্বলে, পাখা ঘোরে। বড় বড় ঘর, মস্ত মস্ত থাম বসানো বারান্দা। যেন রাজার বাড়ি এটি, রাজা নেই উজির নাজির নেই, বাড়ি খালি পেয়ে উঠে এসেছি। বাড়ির লাল নীল হলুদ বেগুনি কাচ লাগানো জানালাগুলো আমার চেয়ে মাথায় লম্বা। আটত্রিশটি সিঁড়ি নেমে গেছে ঘর থেকে উঠোনে। মন্দিরের দেয়ালে যেরকম খোপ থাকে, সে রকম খোপে ভরা ঘরের দেয়াল। খোপগুলো পরে বুজে ফেলেছিলেন বাবা, সিঁড়িগুলো ভেঙেও টানা ইস্কুলঘরের মত বারান্দা বানিয়ে ফেলেছিলেন। এম এ কাহহার নামে পাড়ার এক বিত্তবানের বাড়িতে বাবা দেখেছেন খোপহীন দেয়াল, টানা বারান্দা–আমি অনুমান করি, বাবা এ বাড়িটিকেও সেরকম আদল দিতে কিছু টেনেছেন, কিছু বুজেছেন। বড়লোক দেখলে, বাবাকে দেখেছি, একেবারে মিইয়ে যান। যেন বড়লোকের সব ভাল, তাদের বেঢপ বারান্দাও। তবু বাবা কখন কি করবেন কেউ জানে না, হঠাৎ হয়ত একদিন ট্রাক ভরে বালু এল বাড়িতে, সিমেন্ট এল, ইট এল–দেখে ধারণা হয় সম্ভবত ভাঙা গড়া কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, না ঘটা অবদি কারও সাধ্য নেই বোঝার কী ঘটতে যাচ্ছে। বাবার ইচ্ছের কথা কার সাধ্য আছে বোঝে! আমাদের বাড়িটিই পাড়ার আর সব বাড়ি থেকে উঁচু, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি নীল আকাশ রকম উঁচু। বাড়িটিতে আসবাব পত্র ঢোকানোর আগের রাতে আমি আর ছোটদা এসে এক রাত থেকেছিলাম, ছোটদা তাঁর গিটারখানা নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে, অনেক রাত অবদি গিটার বাজালেন ছোটদা, আর আমি গিটারের হলুদ জামাটির ওপর শুয়ে ছোটদা বলে ডাকলে গমগম করে সাতবার ছোটদা শোনা যেত, তা শুনেছি যেন রাজার সাত ছেলে বাড়ির সাত দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে আর আমাকে ভেঙচি কাটছে আমি যা বলি তাই বলে। আমি কোথায় বললে সাতটি কোথায়, তুমি বললে সাতটি তুমি ভেসে আসে কোত্থেকে যেন। বাড়িটির চারদিক জুড়ে নারকেল আর সুপুরি গাছ। উঠোনে তিরিশ রকম ফুল ফলের গাছ। এমন বড় বাড়ি, আমার বিশ্বাস হয় না, আমাদের। নতুন বাড়িতে আসার পর পর পর কিছু ঘটনা ঘটে, এক নম্বর জানলার শিক ভেঙে বাড়িতে চোর ঢুকে গয়নাগাটি টাকা পয়সা নিয়ে যায়। দঞ্চুনম্বর বাবাকে একদিন রিক্সায় সঙ্গে রাজিয়া বেগম, অলকা হলের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন মা। তিন নম্বর দাদা আর তাঁর বন্ধুরা পাতা নামে একটি পত্রিকা বের করেন, কবিতা গল্প ধাঁধা নিয়ে পাঁচমিশেলি পত্রিকা। সেই পাতা পত্রিকায় রামধনু নামে একটি কবিতা লিখে আমার নামে ছেপে দেন দাদা। কবিতার রচয়িতার নাম নাসরিন জাহান তসলিমা, যদিও বিদ্যাময়ী ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় ইস্কুলের খাতায় ঝুনুখালা খানিকটা ছোট করে আমার নাম তসলিমা নাসরিন লিখেছিলেন।