রাজবাড়ি ইস্কুল ছিল একসময় শশিকান্ত রাজার বাড়ি। সে বাড়ি থেকে রাজা গেল, রাণী গেল, রাজপুত্র রাজকন্যা সব গেল, টেবিল চেয়ার বসিয়ে বিশাল খালি বাড়িটিতে বেঞ্চ আর টুল পেতে খোলা হল ইস্কুল। পুরোনো বটগাছে ঘেরা বাড়ি, বাড়ির সামনে মীরাবাঈএর নগ্ন শাদা মূর্তি। ভেতরে হাঁসের চোখের মত কালো জলের এক পুকুর, পুকুরে শ্বেত পাথরে বাঁধানো ঘাট। বাড়িটির সিঁড়ি নেমে গেছে বাগানে অনেকদূর অবদি। লম্বা দারোয়ানও তাঁর লাঠিখানা ছোঁয়াতে পারে না এমন উঁচু দরজার মাথা, সিলিং তো সিলিং নয়, যেন আকাশ, জানালায় রঙবেরঙের কাচ, ছবি আঁকা। ইস্কুলে ঢুকলে নিজেকে আমার রাজা রাজা মনে হত। ও পর্যন্তই। ক্লাসঘরে গিয়ে দাঁড়ালে একঘর ছেলেমেয়ের মধ্যে আমি একা, বোকা। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে শুনিয়ে গলা ছেড়ে ছড়া বলতে পারি না, ভয়ে শরমে আমার মাথা মাটির দিকে ঝুঁকে থাকে, গলা দিয়ে মিনমিন শব্দ বেরোয় অর্থহীন। মাথায় ডাস্টার মেরে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পেছনের বেঞ্চে। ইস্কুলে আমার নাম হয় না, নাম হয় পরীর মত সুন্দর দেখতে মেয়ে পপির। ড্রইং ক্লাসে হাতির ছবি, ঘোড়ার ছবি, নদী নৌকোর ছবি আঁকতে গেলে হাত কাঁপে আমার। পপি যা আঁকে, তাতেই নম্বর পায় একশয় একশ। আমি ইস্কুলের দুষ্টু ছেলে শরাফের ভাগ্নে। শরাফ আর নাসিমের দু’হাত পেছনে বেঁধে, দু’চোখে কালো পট্টি বেঁধে পেটানো হয়েছিল এক বিকেলে ইস্কুল ছুটির পর। ঘটনা এরকম, নাসিম তার বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে শরাফকে দিয়েছে, আর শরাফ নাসিমকে দিয়েছে চুম্বক। সিঁড়িতে ওদের দাঁড় করিয়ে যেদিন সন্ধিবেত দিয়ে সপাং সপাং পেটানো হল, আমি আর ফেলু মামা ইস্কুলের আর সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাগানে দাঁড়িয়ে মুখ চুন করে দেখেছি। দু’জন একা বাড়ি ফিরেছি সেদিন। শরাফ মামাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ইস্কুলে। সন্ধেয় বেদম মার খেয়ে পড়ে থাকা শরাফ মামাকে বাড়ি ফেরত এনে ঘরের থামের সঙ্গে বেঁধে আরেক দফা পিটিয়েছিলেন নানা।
ইস্কুলের মেয়েরা বইএর ভেতর ফার্ন পাতা ভরে রাখে। ফার্ন পাতাকে ওরা বলে বিদ্যা পাতা। বিদ্যা পাতা বইয়ে রাখলে নাকি ভাল বিদ্যা হয়। আমিও বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যা পাতা ভরে রাখি তবু বোর্ডে অঙ্ক কষার ডাক পড়লে বা ছড়া বলতে গেলে, মাথা মাটির দিকে ঝুঁকে যায়, ছড়া ঝরে পড়ে মাথা থেকে মাটিতে, ধুলোয়।
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
চিকচিক করে বালি কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
এত জানা ছড়াটির একটি শব্দও আমার মনে থাকে না, মনে কেবল ছবি, নদীর ছবি, নদী পার হচ্ছে এক ঝাঁক রাখাল। মনে মনে বলি আহা আমাকে যদি ছড়াটির ছবি আঁকতে দিত! পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে ওঠে মাস্টারের কানমলা খেয়ে শব্দহীন দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখে। খেলার ঘন্টা বাজলে ওরা দৌড়ে যায় দলবেঁধে মাঠে, খেলে। আমাকে কেউ খেলায় নেয় না। রাজবাড়ির সিঁড়ির এককোণে আমি বসে থাকি, জড়সড়, একা। ইস্কুলের সবার সঙ্গে যেন আমার আড়ি। কেউ তাই কথা বলে না, কেউ ফিরে তাকায় না।
আমি নিজেকেই নিজে আড়ি দিই
আড়ি আড়ি আড়ি,
কাল যাব বাড়ি
পরশু যাব ঘর
কি করবি কর।
একা আমি বাড়ি ভর্তি লোকের মধ্যেও। শরাফ মামারা আমাকে খেলায় নেন তখনই, যখন ভাল খেলে এমন কাউকে হাতের কাছে না পান। ওঁদের সঙ্গে দৌড়ে মার্বেল খেলায় লাটিম খেলায় চ্যাড়া খেলায় আমি কিছুতে পেরে উঠি না। ওঁরা গাছে ওঠেন, সাঁতার কাটেন, আমি খেজুর গাছের তলে দাঁড়িয়ে ওঁদের হৈ হৈ আনন্দ দেখি। দাদা এখন আর ক্রিকেট খেলেন না মাঠে, তাঁর নতুন এক বাতিক হয়েছে ছবি তোলা। এক বন্ধুর কাছ থেকে ক্যামেরা ধার করে নদীর ধারে, পার্কে, টেডি প্যান্ট, টেডি জুতো পরে নানা কায়দার ছবি তোলেন আর নিজে হাতে কাগজ কেটে অ্যালবাম বানিয়ে সে সব ছবি সাঁটেন অ্যালবামে। অ্যালবাম দাদা দেখতে দেন দূর থেকে, ছুঁতে দেন না। সকলে ব্যস্ত যার যার খেলায়। সন্ধেবেলা ত্যানায় বালু মেখে হারিকেনের চিমনি মুছে, সলতেয় আগুন ধরিয়ে ঘরে ঘরে রেখে আসার কাজ জোটে আমার, আসলে কাজটি আমি শখ করেই নিই। হারিকেন বাহুতে ঝুলিয়ে, যেন আইসক্রিমঅলা আমি, ঘর থেকে ঘরে যেতে যেতে ডাক ছাড়ি হেই মালাইআইসক্রিম!
রুনু খালা থামান আমাকে প্রথম, এই আইসক্রিম এদিকে আয়। এই নে পয়সা, দুইপয়সা দামের একটা আইসক্রিম দে।
আমার কী যে আনন্দ হয় কেউ ডাকলে! আমি মিছিমিছি পয়সা নিয়ে হারিকেনের মাথা মিছিমিছি খুলে আইসক্রিম বার করে দিই। এ আমার একার খেলা, হার নেই, জিৎ নেই। আমার এই খেলায় ফেলু মামা শরাফ মামা কেউই মজা পান না। বরং টিপ্পনি কেটে বলেন, তুই বরং ছটকুর সাথে খেল। ছটকুর তখন আড়াই বছর বয়স।
আমি বড় হতে থাকি মিছিমিছি। আমার বুদ্ধি হয় না, জ্ঞান হয় না। অন্যের সামনে ছড়া বলতে গেলে ছড়া ঝরে যায় মাথা থেকে মাটিতে। শরাফ মামা ফেলু মামা চোর চোর খেলা ছেড়ে ফুটবল খেলেন, ক্রিকেট খেলেন, আমি তখনও কড়ই গাছের তলায় ছটকুদের সঙ্গে চোর চোরে। আমি তখনও হারিকেনের ওপর গোল করে কাগজ ছিঁড়ে রুটি ভাজার মত কাগজ ভাজি। নামতা রেখার বদলে কাগজ ভরে রঙ পেনসিলে ছবি আঁকি। শনের ঘর, ঘরের পেছনে কলা গাছ, কলা গাছের পেছনে আকাশ, আকাশে পাখি উড়ছে, পাখির পেছনে লাল সূর্য, ঘরের কিনার ঘেঁসে চলে গেছে নদী, নদীতে নৌকো, নৌকোর গলুইয়ে বসা মাঝি, কলস কাঁখে নদীতে জল আনতে যাচ্ছে লাল টুকটুক শাড়ি পরা এক বউ।