মা’র তাই বিশ্বাস হয় না তাঁর কপাল ভাল। বারোই রবিউল আওয়াল তারিখে মেয়ে জন্মে তাঁর কপাল আর কতটুকু ফিরিয়েছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন–আমার কপালের কথা কইস না ফজলি। কপালে আমার সুখ নাই।
ফজলিখালা মা’র হাতের পিঠে হাত রেখে বলেন–আল্লাহর নাম লও। দেখবে মনে শান্তি আসছে। দুলাভাইরে বল নামাজ পড়তে।
ফজলিখালার ফর্সা হাতের দিকে তাকিয়ে মা বলেন–তর দুলাভাই উঠতে বইতে আমারে কালা পেঁচি কয়। হে আল্লাহর নাম লইলে কি আমার কালা রঙ শাদা হইব!
–বড়বু, ফজলিখালা দ্রুত তাঁর ভারি শরীরখানাকে তুলে যেন শাসন করছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন–রঙ আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ যা দিয়েছেন আমাদের তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
খরনদীতে মা খড়কুটো পেলেন একটি ধরার। রঙ আল্লাহর দান। কালো রঙকে নাক সিঁটকেলে আল্লাহকেই নাক সিঁটকোনো হয়।
আমার দুয়ে দুয়ে চার চলছে তখনও, পর পর দুটো ভ্রুণ ঝরে পড়ার পর মা আবার পোঁয়াতি হন। বাবা বদলি হন ঈশ্বরগঞ্জ। বাক্সপেটরা গুছিয়ে বাবার সঙ্গে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঈশ্বরগঞ্জ রওনা হলেন মা। নানি তখন সবে ছটকুর জন্ম দিয়েছেন। মা মেয়ে এ বাড়িতে প্রায় একই সময় পোয়াতি হন।
ঈশ্বরগঞ্জে বাবাকে একটি জিপ দেওয়া হল হাসপাতাল থেকে। জিপে করে দাদাদের ইস্কুলে দিয়ে বাবা কাজে যান। আমার তখনও ইস্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। বাড়িতে বসে মা’র কাছে যুক্তাক্ষর শিখি।
মা’র প্রসবের আগে আগে বাবা জিপে করে ময়মনসিংহ গিয়ে ঝুনু খালাকে নিয়ে এলেন ঈশ্বরগঞ্জ। ইস্ত্রি করা পাজামা জামা আর ওড়না পরে একখানা সুটকেস নিয়ে বাড়িতে নামলেন ঝুনু খালা। কী আনন্দ সেদিন তাঁর! দাদাদের নিয়ে তিনি গপ্পে বসে গেলেন, যেন ছ’মাসে এত কিছু ঘটে গেছে ছ’বছরেও গপ্প ফুরোবে না। ঝুনুখালাকে পড়াতে এক নতুন মাস্টার আসেন, সেই মাস্টার কি করে বোয়াল মাছের মত হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন ঝুনুখালার দিকে, তারই বর্ণনা করেন তিনি অর্ধেক রাত অবদি। নতুন মাস্টারের নাম রাসু। ঈশ্বরগঞ্জে আমাদের বড় দালানবাড়িটি ঝুনুখালা এসে সাজিয়ে গুজিয়ে চমৎকার বানিয়ে ফেললেন। বাবা দেখে বললেন–তুমার বইনরে শিখাইয়া দিয়া যাইও ঘরদোর কি কইরা গুছাইতে হয়। শুনে মা তেতো হেসে বলেন–আমার কোনও কামই তার পছন্দ হয় না। কয়না যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।
বাবা ঝুনুখালাকে টেনে কোলে বসিয়ে পেটে কাতুকুতু দিয়ে বলেন–এই তুই ত দিনে দিনে সুন্দর হইতাছস। তরে যে বেটা বিয়া করব কপাল ভাল তার।
ঝুনুখালা ওড়নায় মুখ ঢেকে বাবার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ান। কান নাক লাল হয়ে থাকে তাঁর শরমে। বাবা ফজলিখালার সঙ্গে আরও সরস হতেন, তাঁকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলতেন– এই যে সুন্দরী, আমার কাছে এট্টু আয় ত, প্রাণডা জুড়াক। জানডা কোরবান কইরা দিতে ইচ্ছা করে তর লাইগা।
ফজলিখালা হাসতে হাসতে বলতেন—খালি ফাজলামি করেন দুলাভাই। শালিদের সঙ্গে এমন ঠাট্টা, বুক টিপে দেওয়া পেটে কাতুকুতু এসব, দুলাভাইদের জন্য হালাল। কথাও যৌনরসে ভিজিয়ে তোলা, কেউ আপত্তি করে না। মা’র তবু মনে হয় বাবা সীমা ছাড়িয়ে যান। রং ফর্সা দেখলে বাবা শালি কি চাকলাদারের বউ কারও গা ছাড়েন না।
ঝুনুখালা আসার ছ’দিন পর মা’র ব্যথা উঠল। খবর পেয়ে দুপুরে হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি ব্যাগ আর একজন নার্স সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবা বললেন এইবার একটা ছেলে চাই আমি। মা’র চিৎকারে আর ডেটলের গন্ধে তখন সারা বাড়ি সয়লাব। মা’র ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট এক ছিদ্রে চোখ রেখে ঝুনুখালা মুখে কাপড় গুঁজে হাসছিলেন আর আর পেছনে দাঁড়িয়ে আমি ও ঝুনুখালা বাচ্চা কেমনে হয়! জিজ্ঞেস করছিলাম। উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করছিল আমার। ঝুনুখালা ছিদ্র থেকে চোখ সরিয়ে বারবারই হাসতে হাসতে লাল হয়ে যাচ্ছিলেন আর আমাকে বলছিলেন বাচ্চা কেমনে হয়, এইডা তরে কওন যাইব না।
ঝুনুখালার হাসি তখনও কমেনি, বাচ্চার কান্নার শব্দ এল। দরজার ছিদ্র আমি নাগাল পাই না বলে ঝুনুখালা আমাকে দু’হাতে উঁচু করে ধরলেন দেখতে। ছিদ্রে চোখ রেখে দেখলাম বাবার হাতে গ্লাবস পরা, গ্লাবসে রক্ত, নার্স বাচ্চাকে গামলার জলে ডুবিয়ে ধুচ্ছেন। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। দেখে আমার গা কেঁপে ওঠে ভয়ে। এত ছুরি কাঁচি নিয়ে বাবা কি মা’র পেট কেটে ফেলেছেন! রক্ত বেরোচ্ছে মা’র কাটা পেট থেকে!মা ব্যথায় কঁকাচ্ছেন! ঝুনুখালা নানির পাঠানো ছোট ছোট কাঁথা হাতে অপেক্ষা করছিলেন বাচ্চা কোলে নিতে। বাবা দরজা খুলে বেরোতেই ঝুনুখালা লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলেন–কি হইছে দুলাভাই? ছেলে না মেয়ে?
বাবা বললেন–যেইটা চাইছিলাম হইল না। মেয়ে হইছে।
–ফর্সা না কালা? ঝুনুখালা জিজ্ঞেস করেন।
–কি আবার, বাবা মুখ ঝামটে বললেন–কালা মায়ের মেয়ে কালা হইব না তো শাদা হইব!
–হাসপাতালে কাজ ফালাইয়া আইছি, আমি গেলাম। বলে বাবা চলে গেলেন। বাবা চলে গেলে আমরা বাচ্চাকে কাঁথা দিয়ে মুড়ে কোলে নিই। গায়ে সর্ষের তেল মেখে শুইয়ে রাখি বিছানায়। ছোট বালিশে মাথা, ছোট কাঁথায় শরীর, ছোট মশারি খেটে মাথার কাছে রেখে নৌকোর মত দেখতে দুধের ফিডার, বসে থাকি। ঝুনুখালাও। মা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন। দাদা আর ছোটদা ইস্কুল থেকে ফিরে বাচ্চাকে চোখ গোল করে দেখেন।
রাতে বাবা ফিরে এলে ঝুনুখালা ভাত তরকারি বেড়ে দেন, খেয়ে শুয়ে পড়েন। বাচ্চা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে উঠলে চেঁচিয়ে বলেন–এই চুপ থাকো ত সবাই। আমারে ঘুমাইতে দেও! ঝুনুখালা শুনতে না পায় কেউ, এমন গলায় না না কাঁদে না বলে বলে বাচ্চার কাঁথা বদলে দেন, মুখে পানি নয়ত দুধ দেন। আমি শুয়ে শুয়ে বিমর্ষ বাড়িটির শব্দ শুনি। বাবার জন্য, মা’র জন্য, বাচ্চার জন্য, ঝুনুখালার জন্য আমার মায়া হতে থাকে। ঈশ্বরগঞ্জ থেকে আবার বদলি হয়ে ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ থেকে ঠাকুরগাঁ। ঠাকুরগাঁ থেকে আবার ময়মনসিংহ। দেড় বছরের মধ্যে বদলির ঘোরাঘুরি শেষে আবার সেই পুরোনো বাড়িতে থিতু হই। জন্মের চেনা বাড়ি। বাবা বলে দেন দাদাদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে, এরপর থেকে বদলি হলে বাবা একাই যাবেন, আর বউছেলেমেয়ে নিয়ে নয়। আমি অনেকটা লম্বা হয়ে গেছি। বাড়িতে বলাবলি হচ্ছে আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করাতে হবে। মা ইয়াসমিনকে, আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা নাম রেখেছেন ইয়াসমিন, দুধ খাওয়ান, গোসল করান, গায়ে সর্ষের তেল মেখে শুইয়ে রাখেন রোদে। সন্ধে হলে আমাকে টেবিল চেয়ারে বসে হারিকেনের আলোয় পড়াতে বসান দাদা। আমি ততদিনে অনর্গল পড়ে যেতে পারি ছড়া কবিতা। ছোট ছোট গল্প। ছোটদের রবীন্দ্রনাথ। দাদা মাস্টারি করলে আমার সব গোল বেঁধে যায়।