শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্রের জীবন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন, তুখোড় রেজাল্ট। ডক্টরেট করতে গেলেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে। অলথ্রু এ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। অধ্যাপক হয়ে ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। তত দিনে সাহিত্যজগতে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন।
কিন্তু ক্লাসের খারাপ ছাত্রটি বৃত্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, স্কুলে হৈচৈ পড়ে গেছে। সেই টিচার পারলে হুমায়ূন আহমেদকে কোলে নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে যান। ছাত্রের ভালো রেজাল্টের গৌরবে স্কুলে তাঁর পজিশনও হাই হয়ে গেছে।
ক্লাস নাইনে ঘটল আরেক ঘটনা।
জেনারেল ম্যাথের টিচার হুমায়ূন আহমেদের খাতা দেখতে দেখতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন, ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০ নম্বর দিয়ে দিয়েছেন।
হেডস্যার অঙ্কের টিচারকে ডেকে পাঠালেন। এটা আপনি কী করেছেন? ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০? অঙ্কের টিচার খেপে গেলেন। ছেলেটা অঙ্কে এত ভালো, আমার ইচ্ছা আমি তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছি। আপনার কোনো অসুবিধা আছে?
হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভূত চরিত্ৰ!
নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারও সঙ্গে মেলে না।
এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।
হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।
নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউমার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়াটারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্পআড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান। তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।
ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা।
সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ। সিঁড়িতে টিমটিম করে জুলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাম্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই উরে বাবা রে বলে একলাফে সরে এলেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন।
খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তার হাত ধরলাম। কী হলো, হুমায়ূন ভাই?
তিনি কোনোরকমে বললেন, মাকড়সা।
মাকড়সা?
হ্যাঁ।
তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিং সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা।
মাকড়সাকে এ রকম ভয়?
সত্যি তা-ই। হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান।
সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম।
আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশার্সদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই। রয়ালটির টাকা পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হূমায়ুন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই! হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-একশ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না।
একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি। তার শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি। খাচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন।
ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম।
আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব।
০৫. ভোরের কাগজ-এর সাহিত্য পাতা
ভোরের কাগজ-এর সাহিত্য পাতায় হুমায়ূন আহমেদ ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন তার মনোজগৎ আচ্ছন্ন করে থাকা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প।
অনেক বছর আগের কথা।
হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিশাল ক্যানভাসের উপন্যাসটি লেখার জন্য স্ত্রী আরও কয়েক বছর আগে তাঁকে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি খাতা উপহার দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে জোছনা ও জননীর গল্প লিখতে শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু কয়েক কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ করে দেন। নীলগঞ্জ হাই স্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। এই লাইনটি দিয়ে উপন্যাস শুরু হয়ে কিছুদূর এগোয়, তারপর আর খবর নেই। লেখা বন্ধ।