ঘটনাটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা আগে বা পরে আজ পর্যন্ত আর ঘটে নি।
সেই সময় দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় মৌনব্রত নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ুন ভাই। ধারাবাহিকভাবে লেখা তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাসই শেষ পর্যন্ত শেষ হয় না। মৌনব্রতীও শেষ হলো না। পরে এই লেখাটি নাম বদলে বই করলেন তিনি। জনম জনম। উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তারা স্বীকার করবেন, জনম জনম এক অসাধারণ উপন্যাস। পরে নিরন্তর নামে আবু সায়িদ ছবি করেছেন। নায়িকা শাবনূর।
আমি হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব উপন্যাস পড়েছি। বহু ভালো উপন্যাস লিখেছেন তিনি। কতগুলোর নাম বলব! নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার-এ দুটো উপন্যাস তো ইতিহাস! তারপর নির্বাসন, সূর্যের দিন, অন্ধকারের গান, চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক, গৌরিপুর জংশন, শ্রাবণ মেঘের দিন, কবি, উনিশ শো একাত্তর, ফেরা, জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল, আগুনের পরশমণি, কোথাও কেউ নেই, রুমাল, শুভ্ৰ, লীলাবতী, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাভাল হাওয়া, বাদশা নামদার-আরও কত উপন্যাস!
তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত ছিলেন বাংলাদেশের খুব বড় একজন শিক্ষিত মানুষ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বেশ কয়েকবার হুমায়ুন ভাই আমাকে রাজ্জাক স্যারের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে নিয়ে গেছেন। মনে আছে, রাজ্জাক স্যার নিজ হাতে পাঙাস মাছের ডিম রান্না করে আমাদের দুজনকে একদিন খাইয়েছিলেন। তাঁর মুখে কী যে প্রশংসা শুনেছি হুমায়ূন ভাইয়ের একেকটি লেখার!
একবার বইমেলায় আবু হেনা মুস্তাফা কামাল বললেন, হুমায়ূন মধ্যবিত্তের নাড়ি স্পর্শ করেছে। তাঁর চোখ গল্পটি পড়ে সংবাদ-এ দুর্দান্ত একটি লেখা লিখলেন। সৈয়দ শামসুল হক চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক উপন্যাসটি পড়ে আহমদ ছফা আমাকে বলেছিলেন, অসাধারণ লেখা! মাত্র কয়েকটি আঁচড়ে বাংলাদেশের চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে হুমায়ূন। ফরহাদ মযহার বলেছিলেন, হুমায়ূনের গল্পগুলোর কোনো তুলনা হয় না। নির্মলেন্দু গুণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর জলিল সাহেবের পিটিসন গল্পটি পড়ে। কলকাতার জিজ্ঞাসা পত্রিকায় হুমায়ূন ভাইয়ের ১৯৭১ গল্পটি ছাপা হলো। আমার সামনে সেই গল্পের এমন প্রশংসা করলেন আল মাহমুদ, হুমায়ূন ভাই লজ্জা পেয়ে গেলেন।
এ রকম কত ঘটনার কথা লিখব!
একই হাতে কত রকমের লেখা যে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের জনক তিনি। প্ৰথম সার্থক সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করেছেন। এখন তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনও ভীষণ জনপ্রিয়।
ভূতের গল্পে হুমায়ূন আহমেদের কোনো জুড়ি নেই। তাঁর মতো এত ভালো ভূতের গল্প বাংলা ভাষার আর কোনো লেখক লেখেন নি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ছায়াসঙ্গী গল্পটির কথা। রহস্য, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার আর অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ের লেখা। দেবী, নিশীথিনী লিখে আরেকটা জগৎ তৈরি করলেন। অন্য ভুবন লিখে আরেকটি জগৎ তৈরি করলেন। আয়নাঘর, পোকা, ভয়-কত লেখার কথা বলব!
সিলেটের একটি মেয়ে-হিমুর সঙ্গেও আমার একবার দেখা হয়েছিল।
সব মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটি নেশার নাম, হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রতিষ্ঠান।
শিশু-কিশোরদের লেখা, রূপকথা—কোথায় তার হাতের পরশ পড়ে নি? আর যেখানে পড়েছে, সেখানেই সোনা ফলেছে।
বাংলা ভাষায় তাঁর প্ৰিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ। ঘন্টার পর ঘন্টা রবীন্দ্ৰনাথের কবিতা মুখস্ত বলে যেতে পারেন। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস-গল্প তাঁর প্রিয়। জন স্টাইনবেক, স্টিফান কিং তাঁর প্রিয়। সারাক্ষণ লেখা নিয়ে ভাবছেন। লেখার ব্যাপারে অসম্ভব খুঁতখুঁতে। মনমতো না হলে সেই লেখা কিছুতেই লিখবেন না। মাথা ভর্তি নতুন নতুন আইডিয়া। সবার মধ্যে থেকেও, তুমুল আড্ডার মধ্যে থেকেও কোন ফাঁকে যেন একা হয়ে যান, লেখার জগতে চলে যান। যখন-তখন লিখতে পারেন। লেখেন মেঝেতে বসে, লেখার জন্য চেয়ার-টেবিল দরকার হয় না। লেখার মতোই অসম্ভব আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে গল্প বলতে পারেন, বাস্তবের সঙ্গে কোথায় যে মিশেল দেবেন। কল্পনা, তিনি নিজে ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। কখনো তিনি নিজেই মিসির আলী, কখনো হিমু।
সব মিলিয়ে এক বিস্ময়কর মানুষ।
কাউকে মা-বাবা ডাকতে পারেন না। নিজের শ্বশুর-শাশুড়িকেও কখনো মা কিংবা বাবা বলে ডাকেন না। কাউকে দুঃখ দিতে চাইলে বেশ ভালোভাবেই তা দিতে পারেন।
নিজের নাটকে একবার এক বিশাল নাট্যব্যক্তিত্বের অভিনয় দেখে এত বিরক্ত হলেন, বললেন, এটা কি অভিনয়? আরে, আপনি তো অভিনয়ই জানেন না।
একবার তাঁর নুহাশপল্লীতে নাটকের রেকর্ডিংয়ে এসে সন্ধ্যার পর কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী অন্য একটি ঘরে বসে হুমায়ূন আহমেদের তুমুল নিন্দামন্দ করছেন। তিনি তো আর তা জানেন না, খুবই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেই ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ঘরের কাছে গিয়েই শোনেন, এই অবস্থা। বাইরে দাঁড়িয়ে খানিক ওসব শুনে মন খারাপ করে ফিরে এলেন। সেইসব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বুঝতে দিলেন না কিছু। আবার পেটে কথাও রাখতে পারেন না। যদি বন্ধুদের কেউ কোনো গোপন কথা বলে বলল, কাউকে বলবেন না, সেটাই সবার আগে বলে ফেলবেন। পাগলের সাঁকো নাড়ানোর মতো।
০৪. ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্প
হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।