আর তার বইয়ের বিক্রি?
অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর কোনো কোনো বই ৮০-৯০ হাজার কপিও বিক্রি হয়েছে। টাকার বস্তা নিয়ে প্রকাশকরা তার বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একসঙ্গে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন কোনো প্ৰকাশক। তাঁর বই না পেয়ে হতাশায় ডায়াবেটিস হয়ে যায় প্রকাশকের। গাড়ি, ফ্ল্যাট হয়ে যায় পর পর কয়েক বছর বইমেলায় তাঁর একটি করে বই পাওয়া ভাগ্যবান প্ৰকাশকের। বইমেলায় যে স্টলে বসেন। তিনি, ভিড় ঠেকাতে সেখানে আট-দশজন পুলিশ লাগে। আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিতেও ক্লান্ত হয় না পাঠক। তাঁর সঙ্গে এক দিনের জন্য আড্ডা দিতে নুহাশপল্লীতে কলকাতা থেকে ছুটে আসেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাড়িতে দেখা করতে আসেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নুহাশ পদক দিতে তিনি ডাকেন সমরেশ মজুমদারকে।
কিশোর-তরুণ-তরুণী তো আছেই, অনেক শ্ৰদ্ধেয় ও বয়স্ক ভদ্রলোকও তাঁর ভক্ত, পেছন, পেছন ঘুরছেন আর স্যার স্যার করছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী, পাঠকপ্ৰকাশক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে তিনি স্যার। নিজ গ্রামে তিনি পীর সাহেব। লোকে তাকে তেমন করে মানে।
ভাবতে বিস্ময় লাগে, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি মাপের রোগা-পটকা একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে এমন আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠেন, কী করে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি!
তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলে ঘোর লেগে যায়। আমি আমার ঘোর কাটাতে আবার পেছন ফিরে তাকাই। হুমায়ুন ভাইয়ের আরও পেছনে ফেলে আসা জীবনটা দেখি।
শ্যামলীর বাসা ছেড়ে হুমায়ূন ভাই এরপর আজিমপুরে চলে এলেন। নিউমার্কেটের দক্ষিণ পাশ দিয়ে সোজা পশ্চিমে বিডিআর গেট, সেই গেটের বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে হাতের ডানদিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে, রাস্তার একপাশে একটা ডোবা আর কয়েকটা কবর, তার উল্টো পাশের বাড়িটির তিনতলায় ফ্ল্যাট।
তত দিনে জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে তার। ঈদ সংখ্যাগুলোতে একটার পর একটা উপন্যাস লিখছেন, বইয়ের পর বই বেরোচ্ছে, প্রতিদিনই বিস্ময়করভাবে বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। প্রকাশকদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন ভাইও প্রায়ই যাচ্ছেন বাংলাবাজারে। নওরোজ কিতাবিস্তানে ইফতেখার রসুল জর্জের ওখানে আড্ডা হয়। প্ৰায় নিয়মিত আসেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ।
কখনো বিউটি বুক হাউস, কখনো স্টুডেন্ট ওয়েজ। আমি যাই। দু-চার দিন পর পরই হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। কোনো কোনো দিন দুপুরবেলা আমাকে তিনি সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। দুপুরে তাঁর ওখানে খেয়ে বিকেলবেলা ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আডা দিতে যাই।
এ সময় টেলিভিশনে শুরু হলো তার দেশমাতানো ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি। নাটকটির পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান। মুস্তাফিজ ভাই তখন আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন। আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই প্রায়ই তাঁর ওখানে যান, স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হয়। কোনো কোনো দিন টিভি ভবনে রেকর্ডিংয়েও যাই আমি।
সেই সময় নিজেদের গ্রামে বাবার নামে একটা পাঠাগার করলেন হুমায়ুন ভাই। নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ এবং আমাকে নিয়ে গেলেন উদ্বোধন করাতে। ফেরার দিন রাতে ময়মনসিংহ শহরে নির্মলেন্দু গুণের বাসায় থাকলাম। উহ, সারাটা রাত নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ যে কী ঝগড়া করলেন! ঝগড়ার শ্রোতা আমি আর হুমায়ূন আহমেদ।
০৩. অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ
এবার অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। তারপর আবার হুমায়ূন আহমেদের পেছনের জীবনের দিকে ফিরব।
হুমায়ুন ভাইয়ের যে-কোনো লেখাই গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে পড়ি। আমার ধারণা, তার এমন কোনো লেখা নেই, যা আমি পড়ি নি।
বছর তিনেক আগের কথা, তখন অপেক্ষা করে থাকতাম তার বলপয়েন্ট লেখাটির জন্য। সাপ্তাহিক ২০০০-এ প্রতিসপ্তাহে বেরোচ্ছে বিলপয়েন্ট। এত স্বাদু রচনা, পড়তে শুরু করলে কখন শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। শেষ হওয়ার পর বিরক্ত লাগে। কেন মাত্র দেড়-দুই পৃষ্ঠা করে লিখছেন তিনি? কেন এই লেখা আরও বড় করে লিখছেন না?
এর মধ্যে একটি পর্বে দেখলাম আমাকে নিয়ে দু-তিনটি প্যারা লিখেছেন। পড়ে সন্ধ্যাবেলা তাকে ফোন করলাম। তিনি বিক্রমপুর থেকে ফোন ধরলেন। বিক্রমপুরের দীঘিরপার এলাকায় নাটকের শুটিং করতে গেছেন। গ্রামটির নাম কামাড়খাড়া।
এই গ্রামের পাশের গ্রাম বাণীখাড়ায় ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি। এলাকাটি আমার বিশেষ পরিচিত। ওই গ্রামে আমার এক দাদার বাড়ি। অর্থাৎ বাবার ফুফাতো চাচার বাড়ি। কিশোর বয়সে বহুবার সেই বাড়িতে গেছি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম রাজতরেখা।
হুমায়ূন ভাই ওই এলাকায় শুটিং করছেন আর সেদিনই অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে ভেবে ভালো লাগল। আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় বললাম, বলপয়েন্ট লেখাটিকে মনে হচ্ছে কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা। কোনো পরিকল্পনা নেই, মাথায় এলোমেলোভাবে আছে স্মৃতিগুলো। কোন স্মৃতি আগের, কোনটি পরের—কোনো হিসাব নেই, কলাম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, লেখাও এগোচ্ছে সেইভাবে। বলপয়েন্টের মূল আকর্ষণ এই জায়গায়।