এ সময় হুমায়ূন ভাইয়ের একবার জন্ডিস হলো। পেঁপে নিয়ে আমি তাকে দেখতে গেছি। জন্ডিসভরা শরীর নিয়েও এমন মজাদার আড্ডা দিলেন তিনি, আমি হতভম্ব। সেদিন প্রথম টের পেলাম, হুমায়ূন আহমেদ পুরনো হতে জানেন না, তিনি প্রতিদিন নতুন। এমন ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ আমি আর দেখি নি। অবলীলাক্রমে নিজেকে নিয়েও ভয়ানক ঠাট্টা করতে পারেন। আর অসম্ভব মেধাবী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, আগাগোড়া যুক্তিবাদী, সম্পূর্ণ স্মার্ট এবং ভয়াবহ শিক্ষিত। জানেন না এমন বিষয় পৃথিবীতে কম আছে। অদ্ভুত সব বিষয়ে আসক্তি। হিপনোটিজম শেখার জন্য আমেরিকা থেকে দুবার নোবেল প্রাইজ পাওয়া প্রফেসর ফাইনম্যানের বই আনলেন। অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলামকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ভূত, বিজ্ঞান, ধর্ম, ম্যাজিক, মানুষ আর মানুষের মনোজগৎ, সাহিত্য, গান, নাটক, সিনেমা, দাবা আর শিশু—এসব একত্রে ককটেল করলে যে জিনিসটা দাঁড়ায়, সেই জিনিসের নাম হুমায়ূন আহমেদ।
প্ৰচণ্ড শীতে নুহাশপল্লীতে শুটিং করতে এসেছে একটি গ্ৰাম্য মেয়ে। মা গেছে মেয়েটির জন্য শীতবস্ত্ৰ জোগাড় করতে। পাতলা জামা পরা মেয়েটি ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে। আগুন জ্বেলে তার চারপাশে লোকজন নিয়ে বসে আছেন হুমায়ুন ভাই। মেয়েটিকে খেয়াল করছেন। আগুনের পাশে আসতে মেয়েটি একটু লজ্জা পাচ্ছে, কারণ এখানকার কাউকে সে চেনে না। এর পরও শীত সহ্য করতে না পেরে আস্তে ধীরে আগুনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই তাপেও তার শীত মানে না। হুমায়ূন ভাই উঠে গিয়ে নিজের কম্বল এনে দেন মেয়েটিকে। তারপর জিজ্ঞেস করেন, তুমি চেন আমাকে? মেয়েটি তাঁর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলে, মনে হয় আপনে হুমায়ূন আহমেদ। আপনেরে আমি চিনছি।
যখন মাথায় যা আসে। সেই কাজ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই হুমায়ূন ভাইয়ের। মনে হলো নুহাশপল্লীতে একটা অ্যাকুরিয়াম থাকা দরকার। বিশাল এক অ্যাকুরিয়াম বসালেন সুইমিংপুলের পাশে। বিদেশি নানা ধরনের মাছের সঙ্গে দুটো দেশি সরপুটি, কয়েকটা ট্যাংড়া, ছোট সাইজের গোটা চারেক ফলি ছাড়লেন। আমরা গেছি নুহাশপল্লীতে, আর্কেটক্ট করিম ভাই গেছেন সস্ত্রীক, তাঁর বছর দু-আড়াইয়ের ছেলে রিয়াদকে নিয়ে অ্যাকুরিয়ামের পাশে গিয়ে বসে রইলেন হুমায়ূন ভাই। রিশাদ তাঁকে ডাকে হাদা, তিনিও রিশাদকে ডাকেন হাদা। দুজনে এমন ভঙ্গিতে গল্প জুড়ে দিল, দেখে করিম ভাই বললেন, দুটো শিশু গল্প করছে।
অনেক বছর আগের কথা! অবসর এবং প্রতীক প্ৰকাশনীর মালিক আলমগীর রহমান তখন গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে থাকেন। তাঁর একমাত্র পুত্র প্রতীকের জন্মদিন। বেশ বড় আয়োজন করেছেন আলমগীর ভাই। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন হুমায়ুন ভাই, মুখে ভয়ংকর এক মুখোশ।
মাজহারের বছর দেড়েকের ছেলে অমিয় যখন-তখন এসে ওঠে হুমায়ুন ভাইয়ের কোলে। অমিয়র একমাত্র নেশা মোবাইল ফোন। মোবাইল দেখলে সে ধরবেই। যার যত মোবাইল হাতের কাছে পান, শিশুর ভঙ্গিতে অমিয়কে তা ধরিয়ে দেন হুমায়ূন ভাই।
শিশুদের সঙ্গে মেশার সময় তিনি শিশু হয়ে যান। এত মনোযোগ দেন শিশুদের দিকে, ভাবা যায় না। আর অসম্ভব আড্ডাপ্রিয়। একা বলতে গেলে চলতেই পারেন। না, দলবল লাগে। কেউ দাওয়াত করলেও একা যান না। দলবল নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমন জায়গায় যাবেনই না। ঠান্ডা খাবার খেতে পারেন না, মাকড়সায় প্রচণ্ড ভয়, হঠাৎ করে রেগে যান। রাগ থাকে। অল্প কিছুক্ষণ। কিন্তু সেই অল্প কিছুক্ষণের ঠেলা সামলাতে জান বেরিয়ে যায়। যার ওপর রাগেন তার সর্বোচ্চ শান্তি কান ধরে উঠবস।
দুটো মাত্র গাল ব্যবহার করেন রাগের সময়, ফাজিল কোথাকার আর খেতাপুড়ি। কৃপণতা বলতে গেলে কিছু নেই। দুই হাতে খরচা করেন। ভালো রান্না না হলে খেতে পারেন না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো খাদ্যরসিক। খান অল্প কিন্তু আয়োজন রাজকীয়। হঠাৎ করে চার হাজার টাকা দিয়ে একটা চিতল মাছ কিনে ফেললেন। ভাবিকে দিয়ে রান্না করিয়ে প্ৰিয়বন্ধুদের ডাকলেন। যত প্রিয় মানুষই হোক, তার বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে যদি দেখেন রান্না খারাপ হয়েছে, মুখের ওপর বলে দেবেন। ভণিতা বলে কোনো কিছু হুমায়ূন ভাইয়ের নেই। সত্য কথা তিনি বলবেনই, কে কী ভাবল তোয়াক্কা করেন না। আপাতদৃষ্টিতে রুক্ষ, কাঠখোট্টা এবং প্রচণ্ড অহংকারী।
নুহাশের আগে তাঁর একটি ছেলে হয়ে মারা যায়, শুনে আমি গেছি দেখা করতে। তখন শহীদুল্লাহ্ হলের হাউস টিউটর তিনি। আমাকে দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, চলে যাও, আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু চোখে পানি ছিল না তাঁর। অথচ নিজের লেখা পড়ে আমি তাকে কাঁদতে দেখেছি। নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে চোখ মুছছেন, কান্নায় বুজে আসছে গলা।
০২. অদ্ভুত একটা স্বপ্ন
অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম একরাতে।
কোথাও বেশ একটা জনকোলাহল। অনেক সুন্দরী নারী। সম্ভবত কোথাও কোনো সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে পেলাম আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। গান-গল্পে মুখর হয়ে আছে। অনুষ্ঠান।
একসময় সুনীল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে এক্ষুনি ছুটতে হবে। প্লেন ধরতে হবে।
তিনি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। তারপর পোশাক বদলে একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন। ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার পেছন পেছন এসো।