হুমায়ূন আহমেদ : যে-কোনো মানুষ একগাদা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতে করতেও নিজের একান্ত ভাবনা ভাবতে পারে। আমি তা-ই করি।
মিলন : একজন মানুষ এত কাজ একা কী করে করে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি অনেক দিন থেকেই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বেকারের হাতে থাকে অফুরন্ত সময়।
মিলন : আগামী দিনের জন্য আপনার কাজের পরিকল্পনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি বাস করি বর্তমানে। ভবিষ্যতে না। কাজেই কোনো পরিকল্পনা নেই।
মিলন : আনন্দ-এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখোন?
হুমায়ূন আহমেদ : ১৯৭১ সালে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার পর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই আমার জন্য আনন্দের। শাওনের সঙ্গে যখন ঝগড়া করি তখনো আনন্দ পাই। মনে হয় বেঁচে আছি বলেই তো ঝগড়া করতে পারছি। আমি যে আপনি কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে বেঁচে আছি বলি, এটাও একটা কারণ। জীবন পরম করুণাময়ের অতি পবিত্র এক উপহার। এই উপহার নিয়ে নিরানন্দে থাকার কোনো উপায় নেই।
১৫. প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ
বাবার মৃত্যুর পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
চার দিন কথা বলতে পারি নি। নিঃশব্দে চোখের জলে ভেসেছি। ১৯৭১ সালের কথা। সেই ঘটনার ৪১ বছর পর গতরাত (বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই) থেকে আমি বলতে গেলে বাকরুদ্ধই হয়ে আছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলো থেকে অবিরাম ফোন এসেছে, কত বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন ফোন করেছেন, ফোন ধরার পরই গলা বন্ধ হয়ে এসেছে। চোখের জলে গাল ভাসতে শুরু করেছে।
হুমায়ূন ভাই নেই, এই বেদনা আমি নিতে পারছি না। গত কয়েক দিন নানা রকমের খবর রটছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল প্রচার করছিল তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। কালের কণ্ঠে সংকটাপন্ন শব্দটা লিখতে আমি মানা করলাম। এই শব্দ আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুধবার সন্ধ্যায় আমেরিকায় ফোন করে মাজহারের কাছে খবর নিয়েছি। তিনি বলেছেন, অবস্থার সামান্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে। শুনে চাপ ধরা বুক খানিকটা হালকা হলো। বৃহস্পতিবার বাসায় ফিরছি, রাত ৯টার দিকে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ফোন করলেন। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। হুমায়ুনের খবর কী, বলো তো? মন খারাপ করা সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি।
রাত ১১টার দিকে ফরিদুর রেজা সাগর ফোন করে বললেন, যখন তখন অশুভ সংবাদটা আসবে। মন শক্ত করো।
ঘণ্টাখানেক পর সেই সংবাদ এলো। টেলিভিশন স্ক্রলে উঠতে লাগল, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ…
এর পর থেকে আমার চারপাশে শুধুই হুমায়ূন আহমেদ। মাথা শূন্য হয়ে গেল, বুক ফাঁকা হয়ে গেল। চোখজুড়ে শুধুই হুমায়ূন আহমেদের প্রিয়মুখ। কত দিনের কত ঘটনা মনে এলো, আমাদের কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনার দিন। যে বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন, ১০-১২ বছর আগে আমরা কয়েকজন তাকে সেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার হার্টের সমস্যা। এনজিওগ্রাম করাবেন। আর্কিটেক্ট করিম ভাই, অন্যপ্রকাশের মাজহার, কমল আর আমিম, গেলাম তার সঙ্গে।
যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলাটার কথা আমার মনে আছে। আমরা সবাই ব্যাগ সুটকেস নিয়ে তাঁর দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে। হুমায়ূন ভাই দলামোচড়া করে দু-তিনটা শার্ট-প্যান্ট ভরলেন একটা ব্যাগে, পাসপোর্ট-টিকিট হাতে নিলেন, ব্যাগ কাঁধে বুলিয়ে বললেন, চলো।
আমি অবাক। আপনি আমেরিকায় যাচ্ছেন, না কুতুবপুর?
নিউইয়র্কে তখন একটা বইমেলারও আয়োজন করেছিল মুক্তধারার বিশ্বজিৎসাহা। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার গেছেন। হুমায়ূন ভাই আর আমিও অতিথি। একই হোটেলে উঠেছি সবাই। কী যে আনন্দে কাটল কয়েকটা দিন! এনজিওগ্রাম করানো হলো হুমায়ূন ভাইয়ের। এক রাত হাসপাতালে থাকতে হবে। কিন্তু ওই একটা রাত একা হাসপাতালে থাকবেন তিনি, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শিশুর মতো ছটফট করতে লাগলেন, চঞ্চল হয়ে গেলেন। আমরা নানা রকমভাবে প্ৰবোধ দিয়ে তাঁকে একটা রাত বেলভ্যুতে রাখতে পেরেছিলাম।
চারপাশে বন্ধুবান্ধব ছাড়া তিনি থাকতেই পারতেন না। একা চলাফেরা করতে পারতেন না। তিনি চলতেন সমাটের মতো। চারপাশে আমরা কয়েকজন তার পারিষদ।
হুমায়ূন ভাই, যে জগতে আপনি চলে গেলেন, সেখানে একা একা। আপনি কেমন করে থাকবেন? সেখানে তো আপনার পাশে আপনার মা নেই, শাওন নেই, নিষাদনিনিত নেই, মাজহার নেই, আমরা কেউ নেই।
আমার ৫০তম জন্মদিনে আমাকে নিয়ে প্ৰথম আলো-তে একটা লেখা লিখলেন হুমায়ূন ভাই, কী কথা তাহার সাথে। (এই নামে এনটিভিতে আমি তখন একটা প্রোগ্রাম করতাম। হুমায়ূন ভাইকে নিতে চেয়েছি, তিনি যান নি। শাওনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।) তাঁর স্বভাব ছিল যে-কোনো লেখা লিখলেই সন্ধ্যার পর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে সেই লেখা পড়ে শোনাতেন। ওই লেখাটাও পড়তে লাগলেন। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। আলমগীর রহমান, মাজহার, আর্কিটেক্ট করিম-আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। তাঁর লেখায়। আমার মুখে শোনা আমার কিশোর বয়সের এক দুর্দিনের বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। সেই অংশটুকু পড়তে পড়তে আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন।
কী গভীর ভালো তিনি আমাকে বেসেছেন, আমি ছাড়া কেউ তা জানে না।
কালের কণ্ঠে তিনি বহু লেখা লিখেছেন। শুরু থেকেই। আমি গিয়ে জোর করে তাঁর লেখা নিয়ে আসতাম। একদিন বললেন, দেড়-দুই বছরে কালের কণ্ঠে যত লেখা লিখলাম, জীবনে কোনো পত্রিকায় এত অল্প সময়ে এত লেখা আমি লিখি নি। কেন লিখেছি জানো? তোমার জন্য।