সমরেশদাকে আমার এই তুমি বলাটা একদমই পছন্দ করতেন না হুমায়ূন ভাই। এই নিয়ে আমাকে একদিন মৃদু বকাঝকা করলেন। ২০০৮ সালের কথা। তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকা-র আমন্ত্রণে কলকাতায় যাচ্ছি। মৈত্রী ট্ৰেন উদ্বোধন হবে, সেই অনুষ্ঠানে। একসঙ্গে দুটো ট্রেন রওনা দেবে। একটা কলকাতা থেকে, একটা ঢাকা থেকে। আনন্দবাজার পত্রিকা ঠিক করেছে। কলকাতা থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যাবেন ঢাকায়, যেতে যেতে একটা লেখা লিখবেন, আর ঢাকা থেকে আমি আসব, আসার পথে একটা লেখা লিখব, পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকা-র ফাস্টপেজে দুজনের রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা লেখা হবে।
আগের রাতে গেছি হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি সব শুনে বললেন, যাচ্ছ ভালো কথা কিন্তু সমরেশদার সঙ্গে দেখা হলে কিছুতেই তাঁকে আর তুমি করে বলবে না।
কলকাতায় যাব আর সমরেশদার সঙ্গে দেখা হবে না, এটা হতেই পারে না।
এক অনুষ্ঠানে দেখা হলো। লেখকদের কলকাতার স্মৃতি নিয়ে অনুষ্ঠান। নামকরা অনেক লেখক সেই অনুষ্ঠানে। আমাকে নিয়ে গেছেন ছড়াকার দীপ মুখোপাধ্যায়। গিয়ে আমি মুগ্ধ। সুনীল শীর্ষেন্দু সমরেশ নবনীতা দেবসেন এ রকম অনেকে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক পবিত্র মুখোপাধ্যায়। সমরেশদার একটু তাড়া ছিল। তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেমন আছেন, সমরেশদা?
সমরেশদা গম্ভীর হয়ে গেলেন। তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে? আজি আপনি আপনি করছো কেন?
আমি আর বলার চান্স পেলাম না, হুমায়ূন ভাইয়ের ভয়ে বলছি।
হায় রে, আমার সেই শাসন করার মানুষটি নেই।
কলকাতায় হুমায়ূন ভাইকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করাবার কাজটি করেছিলেন সমরেশদা। দেশ পত্রিকায় পর পর আট বছর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপা হয়েছে। দেশ পত্রিকার সম্পাদককে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বুঝিয়ে ছিলেন সমরেশদা। আমার ক্ষেত্রেও একই কাজ করেছিলেন। দেশ পুজো সংখ্যা প্রতিবছর ছেপে যাচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, আর আনন্দলোক ছাপিছিল আমার উপন্যাস। আমাদের দুজনকে কী যে ভালোবাসেন তিনি।
সমরেশদা, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই আমার। মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমি। আমাদেরকে কলকাতায় পরিচিত করাবার জন্য তুমি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আমাদের নিয়ে লিখেছিলে, সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় অনেকগুলো লেখা লিখেছিলে। খুব কম লেখকই অন্য লেখকের জন্য এই কাজ করেন। তুমি লেখক হিসেবে হিমালয়ের মতো, মানুষ হিসেবেও। জনপ্রিয়তায় আকাশ স্পর্শ করা লেখক হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ার পর তোমাকে আমি ফোন করেছিলাম। ফোনের একদিকে আমি কাঁদছি, আরেকদিকে তুমি। হুমায়ূন আহমেদের জন্য তোমার ভালোবাসা অক্ষয় হোক।
আরেকজন লেখকের কথা বলে এই লেখা শেষ করি।
তাঁর নাম রমাপদ চৌধুরী। খুবই গুরুগম্ভীর মানুষ। আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরিয় পাতা দেখেন। সমরেশদা হুমায়ূন ভাইকে নিয়ে গেছেন তাঁর কাছে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। হুমায়ূন ভাই রমাপদ চৌধুরীর লেখা পছন্দ করেন। আমাকে বহুবার তাঁর দ্বীপের নাম টিয়া রঙ বইটির কথা বলেছেন। পরিচয় হলো ঠিকই কিন্তু রমাপদ চৌধুরী তাঁর স্বভাবগত কারণেই তেমন কথাবার্তা বললেন না। হুমায়ূন ভাই তাঁর গল্পসমগ্র বইটি রমাপদ চৌধুরীকে উপহার দিয়ে এলেন।
মাসখানেক পর রমাপদ চৌধুরীর একটা চিঠি এল হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে। তিনি লিখেছেন, আমি আপনার গল্পগুলো পড়ে মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়েছি। আপনার বহু গল্প বাংলাসাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। আপনি একজন বিশাল মাপের লেখক।
হায় রে, আমাদের সেই বিশাল মাপের লেখক নেই। আমাদেরকে দরিদ্র করে তিনি চলে গেছেন। এই বেদনা আমরা কোথায় রাখব!
১৪. হুমায়ূন আহমেদের অন্যরকম সাক্ষাৎকার
মিলন : হুমায়ূন আহমেদ, আপনি কেমন আছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : বেঁচে আছি।
মিলন : বেশির ভাগ মানুষকে যদি এ প্রশ্নটা করা হয়, তারা বলেন, ভালো আছি। অথবা এই আছি আর কী। কেউ কেউ কোনো কোনো সমস্যার কথা বলেন। আর আপনি শুধু বলেন, বেঁচে আছি। এ রকম বলার কারণ কী?
হুমায়ূন আহমেদ : বাংলাদেশে আমি অনেক মৃত মানুষকে জীবিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এঁদের আত্মা মরে গেছে। তারা তা জানেন না। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় কেমন আছেন, তাঁরা হাসিমুখে বলেন, ভালো আছি।
মিলন : আপনি এত বড় লেখক, বড় লেখকদের বাড়িভর্তি বই থাকবে, এমনই আমরা আশা করি। আপনার ফ্ল্যাটে তেমন বই দেখছি না কেন? আপনার এই ফ্ল্যাটের সেলফে বইয়ের সংখ্যা কত?
হুমায়ূন আহমেদ : এই মুহূর্তে আমার ফ্ল্যাটে বই আছে বারো শ তেত্রিশ। এটা আমার লেখালেখির বারান্দা। যেসব বই লেখালেখিতে প্রয়োজন সেই বই-ই শুধু এখানে আছে। আমার নিজের লেখা বই একটিও নেই। তবে ঢাকার বাইরে নুহাশপল্লীর লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। দশ হাজারের বেশি বই আছে আমার গ্রামের শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ স্কুলে। একটা কথা, লেখক হতে হলেই বিশাল লাইব্রেরি থাকতে হবে, তা না। প্ৰকাণ্ড লাইব্রেরির মালিকরা কেউই লেখক না।
মিলন : কয়েক বছর ধরে আপনি ছবি আঁকছেন। অনেক ছবিই এর মধ্যে এঁকেছেন। ছবি আঁকার ব্যাপারটি আপনার মধ্যে কীভাবে এল?