সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন দেশ সাপ্তাহিকে সনাতন পাঠক নামে বইপত্রের আলোচনা এবং লেখক বিষয়ক নানারকম খুটিনাটি বিষয় নিয়ে কলাম লেখেন। অন্যদিকে কৃত্তিবাস বের করেন বন্ধুদের নিয়ে।
নন্দিত নরকে নিয়ে তিনি একটি লেখা লিখলেন। তার সেই লেখার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাঠক জানতে পারলেন বাংলাদেশের এক তরুণ তুখোড় ঔপন্যাসিকের কথা, কালক্রমে যিনি কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন।
হুমায়ূন ভাই বোধহয় তারপরই সুনীলদাকে চিঠি লিখেছিলেন। পত্র যোগাযোগ তাদের মধ্যে ছিল। ধীরে ধীরে সেই যোগাযোগ গভীর হলো। সুনীলদা ঢাকায় এলেই হুমায়ূন ভাইর ফ্ল্যাটে আসেন। সাহিত্যের আড্ডা আর গানে, আমাদের তুমুল হৈহল্লায় সময় কাটে। কখনো কখনো স্বাতীন্দিও (স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী) থাকেন।
একবার পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের লেখকদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে কলকাতায়। বাংলাদেশ থেকে সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হুমায়ূন আহমেদ। অনুষ্ঠানের সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার লেখার মতোই অতি সিরিয়াস একটা বক্তৃতা দিলেন। প্রেমের গল্প উপন্যাস যারা লেখেন, হালকা চালের পাঠকমন জয় করা যাঁরা লেখক তাদেরকে খুব একচোট নিলেন। আকার ইঙ্গিতে হুমায়ূন আহমেদকেও একটু ধরলেন, একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন।
হুমায়ূন আহমেদের মতো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ আমি জীবনে দেখি নি। তিনি মুহূর্তেই বুঝলেন ব্যাপারটা। লজ্জা পেলেন, মাথা নিচু করে বসে রইলেন। সুনীলদা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। সভাপতির বক্তব্য দিতে উঠে তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বক্তব্য বিভিন্ন যুক্তিতে খণ্ডন করলেন, প্রেমের গল্প কবিতা উপন্যাস নিয়ে এমন কিছু কথা বললেন, পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের প্রেম বিষয়ক লেখার উদ্ধৃতি দিলেন, হুমায়ূন ভাইয়ের মন ভালো হয়ে গেল। আর কে না জানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পাঠক বাঙালি লেখকদের মধ্যে বিরল। সারা পৃথিবীর সাহিত্য তিনি ভেজে খেয়েছেন।
তারপর আরেকটা কাজ করলেন সুনীলদা।
তখন হুমায়ূন ভাইকে তিনি আপনি করে বলতেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বললেন, হুমায়ূন, আমাদের একটা আড্ডাখানা আছে, নাম বুধসন্ধ্যা। প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আমরা ওখানটায় বসে আড্ডা দিই, গান গল্প করি। কবিতা গল্প পড়ি। কাল বুধসন্ধ্যার একটা গল্প পাঠের আসর আছে। আপনি গল্প পড়বেন।
পরদিন বুধসন্ধ্যায় গল্প পড়লেন হুমায়ূন ভাই। গল্পের নাম আনন্দ বেদনার কাব্য। পড়া শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে গেল হলরুম। একটা সময়ে দেখা গেল শ্রোতারা অনেকেই চোখ মুচছেন।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এ রকম জাদুকর। লিখে মানুষ কাঁদাতে আর হাসাতে তাঁর তুলনা তিনি নিজে।
কলকাতার দুজন লেখকের খুব প্রিয় জায়গা ঢাকা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার। ঢাকায় এলে হুমায়ূন ভাইর ফ্ল্যাটে তাঁরা আসবেনই, নুহাশপল্লীতে গিয়ে একটা রাত হলেও থাকবেন। দুজনেই এত ভালোবাসেন হুমায়ূন আহমেদকে, লেখক হিসেবে এত শ্রদ্ধা করেন, ভাবা যায় না। বড় লেখকের পাশাপাশি এই দুজন মানুষ হিসেবেও বড়, হুমায়ূন আহমেদের মতোই। হুমায়ূন ভাই লেখক হিসেবে যে মাপের, মানুষ হিসেবেও সেই মাপেরই। তাঁর হৃদয় ছিল শরীরের তুলনায় কোটিগুণ বড়।
আরেকজন বড় লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখা এবং ব্যক্তি হুমায়ূনকে খুবই ভালোবাসেন। তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। হুমায়ূন ভাই শীর্ষেন্দুর লেখা যেমন পছন্দ করতেন, মানুষটিকেও পছন্দ করতেন। ঢাকায় এলে হুমায়ূন ভাইর সঙ্গে দেখা শীর্ষেন্দুদা করতেনই। এক দুঘণ্টা গল্প করতেন। ঐশ্বরিক জগতের গল্প, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের গল্প।
শীর্ষেন্দুদার জীবনযাপন অন্যরকম। এক ধরনের স্বাত্ত্বিক জীবনযাপন করেন তিনি। লেখেন অসাধারণ। এখনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা তাঁর লেখা পড়ি।
হুমায়ূন ভাই বেশি পছন্দ করতেন। শীর্ষেন্দুদার কিশোরদের লেখাগুলো। ঢাকার বহু অনুষ্ঠানে শীর্ষেন্দুদার বক্তৃতা শুনেছি আমি। সেইসব বক্তৃতায় হুমায়ূন আহমেদের লেখার উচ্ছ্বসিত প্ৰশংসা করতেন তিনি।
এবার সমরেশ মজুমদারের কথা বলি।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে প্রথম ঢাকায় এলেন সমরেশদা। ততদিনে তিনি বাংলাভাষার জনপ্ৰিয়তম লেখকদের একজন। উক্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ এই ট্রিলজি জনপ্রিয়তার আগের অনেক রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আমরা আবিষ্ট হয়ে আছি সেই ট্রিলজির মায়ায়। তারপর তিনি লিখলেন দুই পর্বের সাতকাহন। এই উপন্যাস আরও একধাপ এগিয়ে নিল তাকে। তার আগে সমরেশদার প্রথম উপন্যাস দৌড়, এই আমি রেণু আর দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দুর্দান্ত একেকটা গল্প পড়ে পাঠক মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়ে আছে।
সমরেশদা ঢাকায় এলেন পার্ল পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী আলতাফ হোসেনের আমন্ত্রণে। আলতাফ সাহেবের ডাকনাম মিনু। আমরা ডাকতাম মিনুভাই। অতি বড় হৃদয়ের অসাধারণ মানুষ।
আহা, কত ভালো ভালো মানুষ আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। মিনুভাইও অকালে চলে গেলেন।
হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে সমরেশদার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিনুভাই। আমার পরিচয়ও মিনুভাইর মাধ্যমেই। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই আমি সমরেশদাকে তুমি বলি। গভীর ভালোবাসা থেকেই বলি। যেমন বলি, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, রবিউল হুসাইনকে।