ইমদাদুল হক মিলন : জনপ্রিয় লেখকের কনসেপ্টটা আসলে কী আপনার কাছে? আপনি আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলেন তো…।
হুমায়ূন আহমেদ : তুমি দেখি এক জনপ্রিয় নিয়ে ঘটঘট করেই যাচ্ছ? ব্যাপারটা কী? জনপ্ৰিয় লেখকের কনসেপ্ট একটাই–বহু লোক তাঁর বই পড়ছে।
ইমদাদুল হক মিলন : এখন বহু লোক তো মার্কেজের বইও পড়ছে, তারাশঙ্করের বইও পড়ছে, হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়ছে, আবার এদিকে রোমেনা আফাজ বা এজাতীয় লেখকের বইও পড়ছে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়ায়?
হুমায়ূন আহমেদ : শোনো মিলন, এত প্যাচালের মধ্যে যেতে চাইছি না। এখন আমার কাছে জনপ্রিয় শব্দটা খুব প্রিয়। ইমদাদুল হক মিলন : প্ৰিয় শব্দ? হুমায়ূন আহমেদ : কারণ জনপ্রিয় শব্দটার প্রথম শব্দ হলো জন, যেখানে জনতা আছে, সেখানে সেই শব্দটাকে আমি ক্ষুদ্র করে দেখব, আমি ওই রকম লোকই না। আমাদের হেমন্তের গান শুনতে ভালো লাগে না?
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ। অবশ্যই।
হুমায়ূন আহমেদ : কত দরদি একজন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এখন বহু লোক তার গান শোনে বলে কি তিনি ছোট হয়ে গেছেন?
ইমদাদুল হক মিলন : না, এখানে কি হুমায়ূন ভাই আপনার মনে হয় জনপ্রিয়তার দুটি ভাগ আছে? ধরেন যে অর্থে মার্কেজ বা তারাশঙ্কর জনপ্রিয়, যে অর্থে আপনি জনপ্রিয়, সেই অর্থে ফুটপাতের চটিবই লেখা একজন জনপ্রিয় লেখক, এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যাটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আসলে ব্যাপার হলো, জনতার কোন অংশ বইটি পড়ছে।
ইমদাদুল হক মিলন : আমি সেটাই জানতে চাইছি। আমি বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে দিই। আপনাকে। ধরেন হেমিংওয়ে বা মার্কেজের জনপ্রিয়তা, তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণের যে জনপ্রিয়তা আর ওদিকে নীহারঞ্জন গুপ্ত। আপনার জায়গাটা কোথায় আসলে?
হুমায়ূন আহমেদ : ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম তো। মিলন, শোনো, একটা সময় ছিল, যখন এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম। এখন মাথা ঘামাই না। এখন মনে হয়, তোমাদের যা ইচ্ছা তোমরা বলো, আমার উপন্যাসকে অপন্যাস বলো, আমার কিছু যায়-আসে না। আমার প্রধান কাজ হচ্ছে লেখালেখি করে যাওয়া, এ কাজটি আমি যদি আমার মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত করে যেতে পারি, আমি মনে করব, এটা আমার জন্য যথেষ্ট। এবং আমি খুবই ভাগ্যবান লেখক যে আমি আমার বইগুলো অনেককেই পড়াতে পারছি। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো বাড়িতে ঢুকে যখন দেখি ওই বাড়িতে চার-পাঁচটা বই আছে, এর মধ্যে একটা নিয়ামুল কোরআন আছে, একটা বিষাদসিন্ধু আছে আর একটা হুমায়ূন আহমেদের বই—আমার যে কী আনন্দ হয়! চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো আনন্দ।
১৩. হুমায়ূন আহমেদের কলকাতার লেখকবন্ধুরা
হুমায়ূন আহমেদ কলকাতার এক হোটেলে উঠেছেন।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় খবর পেয়েছেন। হোটেলে ফোন করে হুমায়ূন ভাইকে বলেছেন, দেখা করতে আসবেন।
হুমায়ূন ভাই সেদিন দুপুরের পরই সময় দিয়েছেন।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সম্পর্কে হুমায়ূন ভাইয়ের তেমন ধারণা ছিল না। পরে ঢাকায়, তার দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটের আড্ডায় ঘটনাটি বলতে বলতে হঠাৎই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দু-চারটা লেখার কথা বলো তো? আমি শ্যামলদার লেখার ভক্ত। ঢাকা কলকাতায় অনেকবার তার সঙ্গে আড্ডা হয়েছে। আমি তাঁর কিছু অসাধারণ লেখার কথা বললাম, কুবেরের বিষয় আশয় ঈশ্বরীতলার রুপোকথা স্বর্গের আগের স্টেশান হাওয়া গাড়ি শাহজাদা দারশুকো এইসব উপন্যাস আর দুতিনটি গল্পের কথা বললাম। যেমন চন্দশ্বেসরের মাচান তলায় পরী গত জন্মের রাস্তা। আর তাঁর বাংলাসাহিত্যে একেবারেই নতুন ধরনের গদ্যভাষার কথাও বললাম।
হুমায়ূন ভাই শুনলেন তারপর ঘটনাটা বললেন।
হুমায়ূন আহমেদ যে অসাধারণ জাদুকরী ভঙ্গিতে লিখতেন, গল্পও করতেন ঠিক সেই ভঙ্গিতে। তিনি কথা বলবার সময় আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে থাকতাম। সেই সন্ধ্যায়ও আছি। তো শ্যামলদা দুপুরের পর পর হুমায়ূন ভাইয়ের হোটেলে এলেন। রুমে বসে চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছে দুই লেখকের। শ্যামলদাকে যারা চেনেন যারা তাঁর লেখা পড়েছেন তাঁরা জানেন, তার রসোবোধ চমৎকার। আর হুমায়ূন আহমেদের রসোবোধের তুলনাই হয় না।
কথায় কথায় শ্যামলদা একসময় বললেন, আমার দাঁতগুলো দেখেছেন হুমায়ূন? কী চকচক করছে! আসলে ফলস দাঁত লাগিয়েছি। এই দাঁতের মুশকিল হলো একটাই, চুমু খেতে অসুবিধা!
হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টানতে টানতে নির্বিকার গলায় বললেন, দাঁত খুলে নেবেন। নিজের খুলতে অসুবিধা হলে প্রেমিকাকে বলবেন মাঝারি সাইজের একটা চড় মারতে, দাঁত আপনা আপনি খুলে বেরিয়ে আসবে।
হুমায়ূন আহমেদের রসোবোধে শ্যামলদা মুগ্ধ।
তারপুর হুমায়ূন ভাই তাঁর অতি বিনয়ী ভঙ্গিতে, হাসিমুখে বললেন, আপনি একবার সন্তোষকুমার ঘোষকে চড় মেরেছিলেন। চড় খেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার চাকরি ছাড়লেন। আমি সেই স্মৃতি মনে রেখে চড়ের কথাটা বললাম। কিছু মনে করবেন না।
কলকাতার লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন ভাইর প্রথম যোগাযোগ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হুমায়ূন ভাইর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে। স্বাধীনতার পর ৭২ সালের শুরুর দিকে সেই উপন্যাসের একটি কপি কেমন কেমন করে গিয়ে পড়ল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। নন্দিত নরকে তখন আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক আলোচিত। বইয়ের ভূমিকা স্বপ্রণোদিত হয়ে লিখেছেন মনীষী আহমদ শরীফ। শওকত আলী প্রমুখ লেখকরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আলোচনা লিখছেন। বাংলাসাহিত্যে একেবারে নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। অতি সাদামাটা সরল ভাষায় মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার গল্প এর আগে এভাবে কোনো লেখক লিখতে পারেন নি।