ইমদাদুল হক মিলন : আমি সাহিত্যের যেটুকু বুঝি, তাতে জানি যে আপনি খুব বড় একজন লেখক। অন্য ভাষায় অন্য দেশে জন্মালে হয়তো আপনি আরও ভাগ্যবান হতেন। দুর্ভাগ্য আপনার, আপনি এই ভাষার, এই দেশে জন্মে গেছেন। আপনার কী মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনার অবস্থানটা কোথায়?
হুমায়ূন আহমেদ: আমার অবস্থান আমাকেই ঠিক করতে হবে? মিলন, শোনো, আমি সাহিত্যের ছাত্র না। আমি কেমিষ্ট্রির ছাত্র। সাহিত্যের বিষয়ে আমার যে জ্ঞান, সেটা হচ্ছে বই পড়ে। এক জীবনে প্রচুর বই পড়েছি। আমাদের সময় তো রেডিও, টিভি—এসব ছিল না; আমাদের একমাত্র জিনিস ছিল গল্পের বই। বিশাল বিশাল উপন্যাস, যেটা আমাদের অল্পবয়সীদের পড়তে দেওয়া হতো না। যেমন ধরো, কড়ি দিয়ে কিনলাম, খাটের নিচে ঢুকে অন্ধকারে পড়ে শেষ করেছি। আমার সাহিত্য সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে, ওই খাটের নিচে ঢুকে বই পড়ে। এমন একজনকে কি সাহিত্যে তার অবস্থান বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক?
ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি এত বড় একজন লেখক, বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আপনার নিজের অবস্থানটা কোথায়?
হুমায়ূন আহমেদ : প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ছাড়বে? আমার অবস্থান ঠিক হবে আমার মৃত্যুর পর। তোমরা সবাই মিলেই ঠিক করবে। এই সময়ে আমি বর্তমানের একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না।
ইমদাদুল হক মিলন : এখানে একটা কথা বলি, যে অবস্থায় হেমিংওয়ে তাঁর জীবদ্দশায় পপুলার, জীবদ্দশায় মার্কেজ পপুলার, জন স্টাইনবেক পপুলার, তাঁদের মতো লেখক সারা পৃথিবীতে বিরল আর আমাদের সাহিত্যে শরৎচন্দ্ৰ জনপ্রিয়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল—এঁরা জনপ্রিয়। এখন এসব লেখকের জনপ্রিয়তার পার্থক্য আছে। আমি বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তার কথা বললে তারাশঙ্করকে বলব। তার সময়ে তার মতো জনপ্রিয় আর কেউ নেই। জনপ্রিয়তার কথা বললে আপনাকে তো কেউ রোমেনা আফাজের সঙ্গে তুলনা করে না, আপনাকে তুলনা করলে তারাশঙ্করের সঙ্গে তুলনা করে, শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার সঙ্গে করে।
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, শোনো, বাংলাদেশে সাহিত্যের থার্মোমিটার হলেন সাহিত্যের অধ্যাপকরা। এ দেশে পাঠকদের ভালোলাগা-মন্দলাগা গ্রাহ্য হয় না। সাহিত্যের অধ্যাপকদের থার্মোমিটারে কী উঠছে, সেটাই গ্রাহ্য। সাহিত্যের থার্মোমিটার বলছে, আমি একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না। কাজেই এটাই সত্য। আমার মৃত্যুর পর নতুন সত্য আসতে পারে, আবার নাও পারে। না এলে নাই। সাহিত্যের অধ্যাপকরা সাহিত্য মাপার নানা যন্ত্রপাতি—থার্মোমিটার, ল্যাকটোমিটার নিয়ে বসে থাকুক। আমি বসে থাকব বলপয়েন্ট নিয়ে। মিলন, ল্যাকটোমিটার কী জানো তো? ল্যাকটোমিটার দিয়ে দুধের ঘনত্ব মাপা হয়। সাহিত্যের সমালোচকদের হাতেও কিন্তু সাহিত্যের ঘনত্ব মাপার ল্যাকটোমিটার আছে। হা হা হা।
বাংলাদেশের একজন সাহিত্যবোদ্ধা আমার উপন্যাসগুলোর জন্য একটা নাম বের করেছিলেন, সেটা তোমার মনে আছে? অপন্যাস।
ভাগ্যিস তার পরই কলকাতার দেশ পত্রিকা আমার অপন্যাস ছাপতে শুরু করল। আমাদের দেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে ওই পত্রিকাটি হিসাবের পত্রিকা।
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ। এটা বাংলা ভাষার কোনো লেখকের ক্ষেত্রে ঘটে নি। প্রতিবছর শারদীয় সংখ্যায় বাংলা ভাষার কোনো লেখকের উপন্যাস ছাপা হওয়া দেশ-এর ইতিহাসে নেই।
হুমায়ূন আহমেদ : থাকুক ওই প্রসঙ্গ। শারদীয় দেশ আমার উপন্যাস ছেপেছে বলে আমি জাতে উঠে গেছি, এটা আমি মনে করি না। আমি লেখালেখি আমার আনন্দের জন্য করি, জাতে ওঠার জন্য করি না। জাতিচ্যুত হওয়ার জন্যও করি না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি তো প্ৰচণ্ড আত্ম-অহংকারী লোক!
হুমায়ূন আহমেদ : আমি চোখমুখ শক্ত করে থাকি বলে আমাকে অহংকারী মনে হয়। তবে কিছু অহংকার আছে। সেই অহংকার নিজেকে ভালো মানুষ ভাবার অহংকার। এর বেশি না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা ভাষার খুব বড় ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটি নিয়ে দেশ পত্রিকায় লিখলেন। ওটা একটা অসাধারণ রচনা। আমার এখনো মনে আছে। আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখলেন আহমদ শরীফ এবং বাংলাদেশের যত বুদ্ধিজীবী আছেন সবাই আপনার প্রশংসা করেছিলেন এই লেখার জন্য। এরপর ড. আনিসুজ্জামান আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলেন। শামসুর রাহমান আপনার লেখার ব্যাপক প্রশংসা করে লিখেছেন এবং বাংলা ভাষার খুব বড় লেখক আমি মনে করি তাকে, জানি না। আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না-তাঁর নাম রমাপদ চৌধুরী, তিনি আপনার লেখা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত চিঠিপত্র লিখেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার একবার কথাও হয়েছিল কলকাতায়। সব কিছু মিলিয়ে আপনার এ ধারণাটা কেন হলো যে এ দেশের দু-একজন কী বললেন না বললেন তার ওপর আপনাকে নির্ভর করতে হবে বা আপনি খুব আশান্বিত হবেন তাদের কথায়?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি যে সময়ের কথা বলেছি, সে সময়…।
ইমদাদুল হক মিলন : না, তার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা আহমদ শরীফের মতো লেখকরা আপনাকে নিয়ে লিখেছেন। শওকত আলী আপনাকে নিয়ে লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ : মানুষের মন খারাপ হয় না? কত আগ্রহ, কত আনন্দ নিয়ে লিখি! কত না বিনিদ্র রজনীর লেখাকে অপন্যাস বলা হচ্ছে, একথা মনে লাগবে না? লেখকরা তো আবেগের সমুদ্রেই লালিত-পালিত।