ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ। এটা আপনার খুব প্রিয় একটা গল্প…
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন গল্পটি পড়ছি, তখন আমার মনে হলো, তিনি আমার পাশেই আছেন। গল্পটি পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি এবং সেই আনন্দটা তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমার ছেলেমানুষি হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আমার প্রায়ই হয়। যেকোনো ভালো লেখা পড়ার সময়ই আমার মনে হয় লেখক আমার পাশে আছেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, ধরেন আপনি লিখছেন, কিন্তু এর পরে কোন লাইনটা লিখবেন আপনি জানেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখক আছেন, যারা প্রতিটি লাইন খুবই চিন্তাভাবনা করে লেখেন। আবার একধরনের লেখক আছেন, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। মাথায় যেটা আসবে সেটা লিখবো। আমার লেখার ওপর খুব একটা কস্ট্রোল আছে—তা না, কন্ট্রোল আছে হালকা, আমার মনে হয় যে আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা বেশি কাজ করে। কিন্তু আমি যখন জোছনা ও জননীর গল্প লিখেছি তখন কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখব। আমি জানি। আমি যখন মিসির আলী লিখি তখন কিন্তু আমি জানি এই লাইনটার পরে আমি কোন লাইন লিখব। সায়েন্স ফিকশন লেখার সময় আমি জানি কোন লাইনটা লিখব। ওই বাকি লেখাগুলোর সময় আমার আর কন্ট্রোল থাকে না।
ইমদাদুল হক মিলন : লীলাবতী লেখার সময় জানতেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না।
ইমদাদুল হক মিলন; লীলাবতীর একটা ছোট চরিত্রের কথা বলি, চঞ্চলী, সে রমিলার বোন। রমিলা মাঝে মাঝে বলে আমি পানিতে ডুবে গেলাম। আমার বোন আমার জন্য ঝাঁপ দিল, আমি উঠে গেলাম। কিন্তু সে আর উঠল না। সে এখন সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। মাগো, এই জন্য আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব না। এই যে চরিত্রটা, আপনি জেনেই লিখেছেন নাকি হঠাৎ?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ হঠাৎ,. হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে, আবার হঠাৎ করেই চলে গেছে। চলে গেছে। যখন এটা নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাই নি। যেমন দীঘির জলে একটা মাছের লেজ ভেসে উঠল। জলে ঘাই দিয়ে তলিয়ে গেল।
ইমদাদুল হক মিলন : এটি ১৩৫৭ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, এখানে আনিস চরিত্রটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে?
[বুঝতে পারছি মিলন এখন প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, আনিস চরিত্রটি যৌক্তিক না। আমাকে এই মুহূর্তে কঠিন অবস্থানে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।]
হুমায়ূন আহমেদ : (কঠিন গলা) মিলন যথেষ্ট হয়েছে। রেকর্ডার বন্ধ করা। চা খাও। আজকের মতো এখানেই ইতি।
[মিলন রেকর্ডার বন্ধ করল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অনেক দিন আগের একটি স্মৃতি আমার মনে পড়ল। তখন শ্যামলীর এক ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমার হয়েছে ভয়াবহ জন্ডিস। মিলন প্রচুর ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। তার মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে আমার বিছানার পাশে বসল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। মুখে কিছুই বলল না। এভাবে সে বসে থাকল। দীর্ঘ সময়। ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা লেখকদের চেয়ে ভালো কেউ জানেন না। কিন্তু গভীর আবেগের সময় যে তারা কিছুই বলেন না—এই তথ্য কি সবাই জানে?
অনেক বছর আগে আমার হাত চেপে ধরে মিলন যে আবেগ প্রকাশ করেছিল, আজও সে তাই করল। হাত সে ধরে আছে ধরেই আছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি এত ভাগ্যবান কেন? মানুষের এত ভালোবাসা কেন আমার জন্য? আমার ঘর ভর্তি চাঁদের আলো। এই আলো আমি কোথায় রাখব?]
১২.০১ হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয় নি যে লীলাবতী উপন্যাসের শেষটা আপনি খুব দ্রুত করেছেন? শেষটা আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার বেশির ভাগ উপন্যাসে আমি শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়া করি। কেন করি তোমাকে ব্যাখ্যা করি—তুমি তো লেখক মানুষ, তুমি বুঝবে। লেখক যখন লেখালেখি করেন, লেখার আগে থেকে পুরো উপন্যাসটা তাঁর মাথার ভেতর ঢোকে। আমি একটা ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখলাম, ৫০০টা পৃষ্ঠা কিন্তু আমি তখন মাথার ভেতর নিয়ে বাস করছি। তখন একটা চেষ্টা থাকে, কত তাড়াতাড়ি আমি জিনিসটাকে মাথা থেকে নামিয়ে দেব। আমি প্রবল চাপ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করি, একই সঙ্গে আমার মাথার ভেতর ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস হাঁটাহাঁটি করে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কুটুরকুটুর করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, ব্যাপারটা একই সঙ্গে আনন্দের ও প্রচণ্ড চাপের। আমার মনে হয়, একজন গর্ভবতী মা। ৯ মাস গৰ্ভধারণের পর সন্তানের জন্ম দিয়ে যে আনন্দ-তৃপ্তি-স্বস্তিটা পান, একজন লেখক ঠিক সেই স্বস্তিটা পান। সেই স্বস্তিটার জন্য আমার তাড়াহুড়া। আল্লাহপাক হয়তো এ কারণেই
ইমদাদুল হক মিলন : আবার লীলাবতী প্রসঙ্গে আসি। মাসুদের স্ত্রীর যখন বাচ্চা হবে, সে বাড়িতে থাকল, তার বাচ্চা হচ্ছে না। তার শাশুড়ি আগেই বলেছিল, তার যমজ বাচ্চা হবে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। তারপর নৌকা করে সে যাচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে তার যমজ বাচ্চা হলো। এই যে এটুকু রহস্য, তাকে আপনি ঝড়-জলের মধ্যে কেন নিয়ে এলেন? রহস্যটা কী? এই কষ্টটা সে তো বাড়িতেও পেতে পারত?
হুমায়ূন আহমেদ : নৌকায় পরীবানুকে নিয়ে, তাকে ঝড়বৃষ্টির হাতে ছেড়ে দিয়ে যে টেনশন তৈরি হয়েছে, পরীবানুকে বাড়িতে রেখে দিলে তা হতো না।