কী?
অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি? (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না)
আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই!
তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ?
আরে!
ওই পর্যন্তই। অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। শোনো মাজহার, একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না।
মাজহার তটস্থ। কী কথা স্যার?
গোপন কথা। বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে… মানে আমি অমিয়র কথা বলছি।
কী হয়েছে স্যার?
মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হায় হায়, বলে কী? নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব!
আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো?
দলের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে। মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর।
আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উল্টো। একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার!
অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার-স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে। এখনও অমিয়ার দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে।
সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দুতিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনেরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।
আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম শচীন দেববর্মণ সড়ক। এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে।
১১. এই লেখাটুকু হুমায়ূন আহমেদের
কিছুদিন হলো আমার জীবনচর্যায় নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। সন্ধ্যা মিলাবার আগেই সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে তিন-চারজন আমার বাসায় উপস্থিত হচ্ছে। আমার মায়ের শোবার ঘরটিতে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এসি ছেড়ে দিচ্ছে। গলা উঁচিয়ে চা-নাশতার কথা বলছে। এই ফাঁকে একজন ক্যাসেট রেকর্ডার রেডি করছে। অন্য একজন ক্যামেরায় ফিল্ম ভরছে। তৃতীয়জন কাগজ-কলম নিয়ে প্রস্তুত। চতুৰ্থজন ব্যস্ত হয়ে মোবাইলে টেলিফোন করছে ইমদাদুল হক মিলনকে। ঔপন্যাসিক চলে এলেই কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ঔপন্যাসিক আমার ইন্টারভিউ নেবেন।
ইমদাদুল হক মিলনের সমস্যা কী আমি জানি না। ইদানীং সে সবার ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়াচ্ছে। টিভি খুললেই দেখা যায়। সে কারও-না-কারও ইন্টারভিউ নিচ্ছে। পত্রিকার পাতাতেও দেখছি অনেকেই তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছিলেন। তারাও রক্ষা পান নি। তিন দিন ধরে ক্রমাগত তাদের ইন্টারভিউ হলো। আমার দখিন হাওয়ার বাসাতেই হলো।
মিলন জানেও না ইন্টারভিউ নিতে নিতে তার গলার স্বরেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। চোখের দৃষ্টিও অন্যরকম। এখন তার চোখে শুধু প্রশ্ন খেলা করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ফাঁদে পা দিলাম? সন্ধ্যাটা আগে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভালোই কাটত। এখন ক্যাসেট প্লেয়ার মুখের সামনে ধরে মিলন বসে থাকে। সামান্য বুকে এসে প্রশ্ন করে—
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস লীলাবতী দিয়েই শুরু করছি। এটা পড়ে মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্র হচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান। এই উপন্যাসটির নাম সিদ্দিকুর রহমান বা সিদ্দিকুর রহমানের জীবন এ রকম হতে পারত। অনিল বাগচীর একদিন নামে আপনার একটা বই আছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামেই যদি নামকরণ করেন, তাহলে উপন্যাসটির নাম লীলাবতী কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো মনে করি যে, লীলাবতী উপন্যাসে যে কটি চরিত্র এসেছে, প্রতিটিই প্রধান চরিত্র।
[ভুল উত্তর। উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রধান হতে পারে না। ঔপন্যাসিক মিলন অবশ্যই এটা জানে। কিন্তু সে এমন ভাব করল যেন সে আমার উত্তর গ্রহণ করেছে। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল–]
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে লীলাবতী নামটি কেন রাখলেন?
[প্ৰবল ইচ্ছা হলো বলি–আমার ইচ্ছা। তোমার কী? এই জাতীয় উত্তর দেওয়া যায় না। অনেক পাঠক পড়বে। জ্ঞানগর্ভ কিছু বলা দরকার। জ্ঞানগর্ভ কিছু মাথায় আসছে না। কী করি? উপন্যাসের নাম নিয়ে মিলনের মাথাব্যথার কারণটাও ধরতে পারছি না। আমি বললাম–]
হুমায়ূন আহমেদ : উপন্যাসের নাম হিসেবে লীলাবতী নামে যে মাধুর্য আছে সিদ্দিকুর রহমান নামে কি সে মাধুৰ্য আছে?
ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই এটা একটা সুন্দর নাম।
[মিলন মুখে বলল, এটা একটা সুন্দর নাম; কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলো সে আমার কথাবার্তায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো-আচ্ছা মিলন কি ভাবছে আমি লীলাবতী নামটি বাণিজ্যিক কারণে রেখেছি? তাই যদি হয় তাহলে তো নামকরণের ব্যাপারটি ভালোমতো ব্যাখ্যা করা দরকার। বইয়ের ফ্ল্যাপে এই ব্যাখ্যা আছে। আমি পরিষ্কার বলেছি-ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কন্যার নাম লীলাবতী। এই নামটির প্রতি আমার অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তবে আমি এত ব্যাখ্যায় গেলাম না, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলাম–]