আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই
শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন—
মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে
এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর।
তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত)
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে
বাজে ভাঙা ঢোল
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন–
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলামায়ের কোল।
আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়। শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে।
২০০৫ সালে সেই সুযোগ হলো।
পদ্মা গোমতী সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্ৰকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে।
হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে; অন্যপ্রকাশের মাজহার, কমল আর নাসের সন্ত্রীক। মাজহারের বড় ছেলে অমিয় তখন খুব ছোট। শাওন তখনো মা হন নি।
বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে আখাউড়া। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের। তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচাৰ্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই। তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পৌঁছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে।
শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে তার লেখা পড়েছি। বেশির ভাগই প্ৰবন্ধ। মুগ্ধ হলাম যে বই পড়ে, সেই বইয়ের নাম মুক্তো। জন স্টাইনবেকের পার্ল-এর অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি। আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব।
হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান। তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন। কালো বুদ্ধিজীবী।
আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি। সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তার ফেরা উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন আমাদের মানিকবাবুকে।
রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন আগরতলার মহারাজরা। এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে।
আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে।
বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা। আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাব্ধি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে।
একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম। আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক। হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন।
আমাদের দিনগুলো কাটছিল। এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি।
প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে এক শ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক। কিসের টাকা, দাদা?
আপনি চা-টা খাবেন। না না, টাকা আমি নেব না।
কেন?
এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন?
আমরা হতভম্ব!
আগরতলার নীরমহল খুব বিখ্যাত পৰ্যটনকেন্দ্ৰ। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি। সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়। একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা।
আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম।
ঘটনা হলো কী, পদ্মা গোমতী থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে। রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচাৰ্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল।
মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই। চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে। সে আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা পদ্মা গোমতী বোঝে না, সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না।
হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তাপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটা কাজ করব নাকি?