এক দুপুরে কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখি আবু ইসহাক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে আমার মনে হয়েছিল দৃশ্যটা বাস্তব, না আমি স্বপ্ন দেখছি!
এত বড় একজন লেখক আমার ফ্ল্যাটে!
আবু ইসহাক সাহেবের হাতে একটা বই। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ। বইটি তিনি আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য বাংলাবাজার থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আমার ফ্ল্যাটে এসেছেন।
সেটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
পদ্মার পলিদ্বীপ-এর প্রথম নাম ছিল মুখর মাটি। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার পত্রিকায় মুখর মাটি নামে ছাপা হচ্ছিল। পাশাপাশি ছাপা হচ্ছিল। আমার প্রথম উপন্যাস যাবজীবন। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। রফিক আজাদ। বই করার সময় প্রচুর ঘষামাজা করেছেন ইসহাক সাহেব, নাম বদলেছেন। বাংলাদেশের নদী আর চরের জীবন নিয়ে পদ্মার পলিদ্বীপ-এর মতো উপন্যাস আর একটিও লেখা হয় নি। এ এক কালজয়ী উপন্যাস।
আমার ওই ফ্ল্যাটে একদিন এলেন চার যুবক। তাদের সঙ্গে পরিচয় বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। পজিট্রন নামে একটি প্রকাশনা করেছেন। এখন অন্যদিন নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা করবেন এবং প্রকাশনা করবেন। বাংলা একাডেমীতে পরিচয়ের সময়ই আমার বই ছাপার আগ্রহ প্ৰকাশ করলেন। তখনো তাদের প্রত্যেকের নাম জানা হয় নি। যেদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন, নাম জানলাম চারজনেরই মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, সিরাজুল কবির চৌধুরী (এই যুবকের ডাকনাম কমল) আর আবদুল্লাহ্ নাসের। তারা আমার বইয়ের জন্য এসেছেন।
চা খেতে খেতে মাজহার আচমকা একটা পলিথিনের শপিং ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে দুই লাখ টাকা আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলায় আপনার একটা বই চাই।
আমি কী করব খানিকক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। সেদিনকার আগে দুই লাখ টাকা আমি একসঙ্গে কখনো চোখেই দেখি নি। একটা বইয়ের জন্য এত টাকা অগ্ৰিম! এই টাকা দিয়ে কী করব বুঝতেই পারছিলাম না।
মাজহারদের সেই টাকায় আমার জীবন ঘুরতে শুরু করেছিল। হুমায়ূন ভাইয়ের ক্ষেত্রে আরও বড় ঘটনা ঘটালেন এই চার যুবক। হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাজির একদিন-স্যার, আমরা আপনার একটা বই করব?
হুমায়ূন ভাইয়ের তত দিনে অনেক প্রকাশক। ঈদসংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক লিখছেন বিটিভিতে (তখনো স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো আসে নি)। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন, একটা বইয়ের জন্য আমাকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হবে।
তারা একটু চমকালেন, চিন্তিত হলেন। সম্ভবত ৯৭-৯৮ সালের কথা। কোনো কথা না দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হুমায়ূন ভাই ভাবলেন, যাক ঝামেলা গেছে।
হুমায়ূন ভাই তখন সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা করছেন। বিজয়নগরের ওদিকে একটা অফিস নিয়েছেন। মাজহাররা চারজন পরদিন সেই অফিসে গিয়ে হাজির। একজনের হাতে বাজার করার চটের বড় একটা ব্যাগ। হুমায়ূন ভাইয়ের সামনে গিয়ে ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন- স্যার, এই যে ১০ লাখ টাকা। বই দেবেন কবে?
তার পরের ইতিহাস আর বলার দরকার নেই। এখন অন্যপ্ৰকাশ বিশাল ব্যাপার। হূমায়ুন ভাইয়ের প্রধান প্রকাশক। বাংলা একাডেমী বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে পৌঁছতে ২০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা সময় লাগে, এমন লাইন। শুধু হুমায়ূন ভাইয়ের বইয়ের জন্য।
আমি একবার বলেছিলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের কারণে বাংলা একাডেমীর বইমেলা একদিকে কাত হয়ে গেছে। শুনে তসলিমা নাসরিন খুব হেসেছিলেন।
১০. পদ্মা গোমতী
পদ্মা গোমতী বেশ নামকরা সংগঠন।
বাংলাদেশ এবং আগরতলা মিলিয়ে কার্যক্রম চলে সংগঠনের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পদ্মা গোমতীর সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান আর আগরতলার হচ্ছেন অনিল ভট্টাচার্য। এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ত্রিপুরা দৰ্পণ পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দত্ত, কবি রাতুল দেববর্মণ প্রমুখ।
রাতুল দেববর্মণ বিখ্যাত দেববর্মণ পরিবারের লোক। শচীন দেববর্মণ ও রাহুল দেববর্মণ আলোকিত করেছেন যে পরিবার। শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণও কম বিখ্যাত নন। কী অসাধারণ সব গান লিখেছেন! আর শচীনকর্তার গানের কথা না-ই বা বললাম। বাংলা গানে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সুরের মায়ায় এবং কষ্ঠের জাদুতে শচীন কর্তা বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙাল মুলুক ছাড়িয়ে বোম্বেতে (আজকের মুম্বাই) পাড়ি জমালেন। হিন্দি গানের জগতেও হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এমন সব বিখ্যাত ও হিট ছবির সুর করলেন, উপমহাদেশ মাতিয়ে দিলেন। লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, কিশোরকুমার-আরও কত কত গায়ক তাঁর সুর করা গান গেয়ে জগৎ জয় করলেন! শচীন দেববর্মণের সুর করা বহু হিন্দি ছবি থেকে দুটোর কথা বলি। একটি ছবির নাম অমর প্রেম। অভিনয় করলেন রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর। কিশোরকুমার তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে গাইলেন হৃদয় তোলপাড় করা গান। মূল গল্প বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কী অসাধারণ প্রেমের গল্প, কী অসাধারণ প্রেমের ছবি!
আরেকটি ছবির নাম গাইড। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণের গল্প, অভিনয় করলেন দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রেহমান। গানগুলোর কোনো তুলনা হয় না। দুটো ছবিতেই শচীনকর্তা নিজের কণ্ঠ সামান্য একটু ব্যবহার করলেন। অমর প্রেম-এর গানটির একটি লাইন আমার মনে পড়ছে, ও মাইয়ারে…। গাইড-এ দু-তিন লাইনে তিনি গেয়েছিলেন গ্রামবাংলার বিখ্যাত সেই গান–