যা হোক, ওই টিনশেডের বাসায় এক গরমের দুপুরে বসে ঘামে ভিজতে ভিজতে সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখেই রুজি-রোজগারের চেষ্টা করব। এ ছাড়া আমি অন্য কোনো কাজ জানি না। ৭৭ সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় ঢুকেছিলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। পুলিশ নিয়ে রিপোর্ট লেখার কারণে চাকরি চলে গিয়েছিল।
এসব কথা আগেও কোথাও কোথাও লিখেছি।
কিন্তু লিখে জীবনধারণের সিদ্ধান্তটা তখন ছিল প্রায় আত্মঘাতী। পত্রপত্রিকা বলতে গেলে হাতে গোনা দু-চারটা। একটা গল্প লিখলে পাওয়া যায় বড়জোর ২০ টাকা। তাও সে টাকা তুলতে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া চলে যায় অর্ধেকের বেশি।
বিটিভি একমাত্র টিভি চ্যানেল। তিন মাসে ছয় মাসে একটা নাটক লেখার সুযোগ মেলে। তাও নানা প্রকার ধরাধরি, তদবির। শেষ পর্যন্ত নাটক প্রচারিত হলে টাকা পাওয়া যায় শ চারেক।
পাবলিশাররা বই ছাপলে সেই বই কায়ক্লেশে পাঁচ-সাত শ-এক হাজার বিক্রি হয় বছরে। রয়্যালিটি যেটুকু পাওয়া যায় তাতে মাসখানেক চলা মুশকিল।
এ অবস্থায় ও-রকম সিদ্ধান্ত।
তবে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ আমি শুরু করলাম। আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসি। টানা ১১টা ১২টা পর্যন্ত লিখি। এক ফাঁকে গরিব মানুষের দিনদরিদ্র নাশতাটা সেরে নিই। তারপর যাই বাংলাবাজারে, প্ৰকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরি। কোথাও কোথাও বসে আড্ডা দিই। দুপুরে কেউ কেউ খাওয়ায়। যেদিন ও রকম হয় সেদিন আর বাড়ি ফিরি না। একবারে আড্ডা-ফাডা দিয়ে রাতে ফিরি।
হুমায়ূন ভাইও তখন দু-একদিন পরপরই বাংলাবাজারে আসেন। বিউটি বুক হাউস, স্টুডেন্ট ওয়েজ আর নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আড্ডা দিই, চা-সিগ্রেট খাই।
ও রকম একদিনের ঘটনা।
আমরা দুজনই এক প্রকাশকের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছি। দুপুরের দিকে হুমায়ূন ভাই বললেন, চলে আমার বাসায়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। চলুন।
বাংলাবাজার থেকে রিকশা নিলাম। যাব আজিমপুর। তখনো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ আধুনিক হয় নি। আমাদের বইপত্র তৈরি হয়। হ্যান্ড কম্পোজে, প্রচ্ছদ তৈরি হয়। হাতে তৈরি ব্লকে। অফিসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা তখনো ভাবতে পারেন না অনেক প্ৰকাশক।
আমার প্রথম বই ভালোবাসার গল্প ছিল ১২ ফর্মার। দাম ছিল ৭ টাকা। আমি রয়্যালটি পেয়েছিলাম ৪০০ টাকা। হুমায়ূন ভাইয়ের নন্দিত নরকের দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা।
তখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা হলে বাংলাবাজার এলাকার কোনো গলির ভেতর একটা রুম ভাড়া নিয়ে কম্পোজ সেকশন করা যেত। সিসা দিয়ে তৈরি টাইপ সাজানো থাকে একধরনের কাঠের ছোট ছোট খোপওয়ালা পাত্রে। সামনে টুল নিয়ে বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী লাইনগুলো তৈরি করে কম্পোজিটর, পৃষ্ঠা তৈরি করে। একেক খোপে একেক অক্ষরের টাইপ। ১৬ পৃষ্ঠা তৈরি হলে এক ফর্মা। ভারী একটা তক্তার ওপর ওই টাইপের দুটো করে পৃষ্ঠা। মোট আটটি ও-রকম কাঠের তক্তা চলে যায় মেশিনে। অর্থাৎ একটা ফর্মা।
এভাবে ছাপা হয় বই।
যারা বই ছাপার কাজ করে, ও-রকম প্রেসগুলোরও অনেকেরই থাকে কম্পোজ সেকশন। ওসব ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্টটা বেশি। আর মেশিন ছাড়া শুধু কম্পোজ সেকশন ছোটখাটোভাবে করেও অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে কেউ কেউ।
ও রকম কম্পোজ সেকশনের একটা সমস্যা হলো কম্পোজিটরীরা অনেকেই সিসায় তৈরি টাইপ চুরি করে নিয়ে সের দরে বিক্রি করে ফেলে। পার্টনারশিপে যারা কম্পোজ সেকশন করে তারা নিজেরাও এক পাটনার আরেক পার্টনারের অজান্তে টাইপ চুরি করে। বিক্রি করলেই তো ক্যাশ টাকা।
একটা বিজনেস করি।
হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টান দিয়ে বললেন, কী বিজনেস?
একটা কম্পোজ সেকশন করি।
হ্যাঁ। করা যায়। ভালো আইডিয়া।
কত টাকা লাগবে?
একেকজনে দশ-পনেরো হাজার করে দিলে হয়ে যাবে।
সেটা দেওয়া যাবে।
তাহলে চলেন শুরু করি।
তোমার টাকা রেডি আছে?
আরে না। দশ টাকাও নেই।
তাহলে?
ধার করতে হবে।
সেটা না হয় করলে, তবে আমার একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
হুমায়ূন ভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। চুরি করে টাইপ বিক্রির অধিকার সমান থাকতে হবে।
আমি হাসতে হাসতে রিকশা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ি।
আমাদের ব্যবসার ওখানেই যবনিকাপাত।
০৯. পেপারব্যাকে উপন্যাস
পেপারব্যাকে উপন্যাস লেখার জন্য সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর দিককার সাদা অংশে হুমায়ূন ভাই লিখলেন, ১০০০ (এক হাজার) টাকা বুঝিয়া পাইলাম। উপন্যাস লেখার জন্য ওটাই তাঁর জীবনের প্রথম অগ্ৰিম নেওয়া। হাতের কাছে কাগজ ছিল না বলে সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার পেছন দিকে লেখা হলো। এই ঘটনা ঘটল মুনতাসীর মামুনের বাসায়, মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনিতে।
সেই বাসা বা বাড়িটি বোধহয় এখনো মামুন ভাই রেখে দিয়েছেন। ইস্পাহানি কলোনির ভেতরে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন গাছপালায় ঘেরা, সামনে সবুজ ঘাসের লন, হলুদ একতলা পুরনো ধরনের স্টাফ কোয়ার্টার করেছিল ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষ। স্নিগ্ধ নির্জন সুন্দর পরিবেশ। ও রকম কোয়ার্টারে সেই সময় থাকতেন মামুন ভাই। এখনো কোয়ার্টারটি তাঁর আছে, তবে তিনি ওখানে থাকেন না। প্রতিটি রুম ভর্তি বই। শুনেছি তিনি অনেক সময় লেখালেখির কাজ করতে যান ওখানে।
১৯৮৫ সাল। ২০-২২ দিন ধরে সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলছে। আলমগীর রহমান কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রা-য়। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। শাহরিয়ার কবির, মাহফুজউল্লাহ, রেজোয়ান সিদ্দিকী কাজ করেন। মুনতাসীর মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক অথবা সহকারী অধ্যাপক। তার পরও বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিচিত্ৰায়। সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলে বলে অফিসে বসে চা-সিগারেট খেয়ে সময় কাটে সবার।