আমার এমনিতেই সারা দিন ধরে মন খারাপ। হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতায় হাসার চেষ্টা করছি, হাসতে পারছি না। জুয়েল আইচের মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। তিনি আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু সবসময়কার মতো প্ৰাণ খুলে হাসতে পারলেন না। আমি মাথা নিচু করে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে বসে আছি। খানিক পর শাওন এসে বসল। পাশে। সে খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত; একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, ভেতরের গভীর কষ্ট অতিকষ্টে চেপে সে উচ্ছল থাকার চেষ্টা করছে। আমার চোখ ভরে আসছিল কান্নায়, গোপনে চেপে রাখছিলাম চোখের পানি।
হুমায়ূন ভাই নানা রকম কথা বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর চিরাচরিত রসিকতাও করছিলেন। আমি না থাকলে তো তোমার অনেক সুবিধা। তুমি তখন একচ্ছত্র রাজত্ব করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
শাওন উচ্ছল গলায় বলল, না না, মিলন আংকেলকে একক রাজত্ব করতে দেওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ কমপক্ষে আরও ২০ বছর আছে।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের কারও কারও মনে হতে পারে শাওন আমাকে কেন মিলন ভাই না বলে মিলন অ্যাংকেল বলছে। আসলে আমাদের কয়েকজনের ক্ষেত্রে শাওন তার অভ্যাসটা বদলাতে পারে নি। যেমন—আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আলমগীর রহমান কিংবা আমি। আমি শাওনকে চিনি ওর শিশু বয়স থেকে। বিটিভির নতুন কুড়ির সময় থেকে। শাওনের গুণের পরিচয় তখন থেকেই জানি। ওর অসাধারণ অভিনয়ের কথা, অসাধারণ গায়কি প্রতিভার কথা, এমনকি টিভি নাটক পরিচালনার কথা সবাই জানে। আমি তার আরেকটা বড় প্রতিভার কথাও জানি। শাওন খুবই উচ্চমানের একজন নৃত্যশিল্পী। এখন আলোকিত করছে হুমায়ূন আহমেদের জীবন, একসময় আলোকিত করেছিল নতুন কুঁড়ি প্ৰতিযোগিতা।
কথায় কথায় কত কথা যে আসে!
শাওনকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন ভাইয়ের নাটকের শুটিং ছিল। আমি আর ইফতেখার নামে হুমায়ূন ভাইয়ের এক বন্ধু গেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। নাটকের নায়িকা শাওন। পরদিন ইউনিভার্সিটিতে তার জরুরি ক্লাস। বিকেলবেলা ফিরতে হবে। আমি আর ইফতেখার ভাই যে মাইক্রোবাসে ফিরব, শাওনও সেই মাইক্রোবাসে আমাদের সঙ্গে রওনা দিল। রাস্তায় হঠাৎ আমি শাওনকে বললাম, শাওন একটু পুরনো দিনের হিন্দি গান শোনাও না। দু-চার লাইন যা পারো।
ধারণা ছিল, শাওন এই জেনারেশানের মেয়ে, ও কি আর পুরনো দিনের হিন্দি গান পুরোপুরি জানে কোনোটা? হয়তো দু-চার লাইন গাইতে পারবে।
শাওন আমার ধারণা তছনছ করে দিল। একটার পর একটা পুরনো দিনের হিন্দি গান গাইতে লাগল। সামসাদ বেগম, নূরজাহান, লতা মুঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, এমনকি মোহাম্মদ রফি, মুকেশের গানও। এমন নিখুঁত সুরে, একটি শব্দও ভুল না করে একের পর এক গেয়ে গেল। শাওন একটা করে গান শুরু করে, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকাই।
নুহাশপল্লী থেকে ঢাকা, সারাটা পথ পুরনো দিনের হিন্দি গান গেয়ে শোনাল শাওন। ওর গান শুনতে শুনতে আমি চলে গেলাম। আমার ছেলেবেলায়, কৈশোরকালে। সেই সময়কার আমার পুরান ঢাকার জীবনে, যেখানে চায়ের দোকানে দিনরাত বাজত এসব গান। গ্রামোফোনে, রেডিওতে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানেও বাজত।
বাংলার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বাইতে (তখনকার বোম্বাই) গিয়ে হয়েছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি গান গেয়ে নাগিন ছবির সুর করে ভারতবর্ষ মাত করে দিলেন। সেদিন শাওন শেষ গানটা গেয়েছিল হেমন্তকুমারের আয় আপনা দিল তো আওয়ারা।
০৮. বিজনেস প্ল্যান
হুমায়ূন ভাই আর আমি যে একবার বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম, সেই ঘটনা বলি।
১৯৮৫ সালের কথা। হুমায়ূন ভাই থাকতেন আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিমউত্তর দিককার গলির ভেতর তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে। আমি গেণ্ডারিয়ায়। হুমায়ূন ভাইয়ের তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাকরি আছে, তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আমি একেবারেই বেকার। বাড়ি থেকে বিতাড়িত। থাকি কলুটোলার একটি বাসায়। চারদিকে ইটের দেয়াল, মাথার ওপর টিনের চাল। আমার স্ত্রী লজ্জায় ওই বাসায় আসেন না। তিনি থাকেন কাছেই তাদের তিনতলা বাড়িতে।
বিতাড়িত হওয়ার পর শাশুড়ি আমাকেও তাদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ব্যৰ্থ লোকদের অহংকার তীব্ৰ হয়। আমার পকেট দশটা টাকাও নেই। তবু শ্বশুরবাড়িতে না থেকে বারো শ না পনেরো শ টাকা দিয়ে যেন ওই টিনশেড ভাড়া নিয়েছি। শ্বশুরবাড়ির কাছেই।
এই বাসায় আমাকে একদিন দেখতে এসেছিলেন কবি রফিক আজাদ। আমার শোচনীয় অবস্থা দেখে নানা ধরনের জ্ঞান দিয়ে চলে গেলেন। লেখকদের জীবন এ রকমই হয়… ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণও দিলেন।
আমার কি আর ওসব কথায় মন ভালো হয়!
মন ভালো করার জন্য দু-একদিন পরপরই হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে যাই। দুপুরে তাঁর ফ্ল্যাটে খাই, বিকেলে আড্ডা দিতে যাই ইউনিভার্সিটি ক্লাবে। দু-একদিন হুমায়ুন আজাদের বাসায়। শামসুর রাহমান, সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর এই অধম, আমরা ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসির এক ভদ্রলোকের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটেও আড্ডা দিতে যাই কোনো কোনো সন্ধ্যায়। অর্থাৎ আমার খুবই এলোমেলো জীবন।
এর আগে ও পরে আমি বেশ কয়েকবার ছোটখাটো নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছি। শুরু করার পর সেইসব ব্যবসায় লালবাতি জুলে যেতে একদম সময় লাগে নি। আমার ধারণা, আমার মতো ব্যৰ্থ ব্যবসায়ী এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি তাহলে একটা চ্যাপ্টারের শিরোনাম হবে আমার ব্যৰ্থ ব্যবসায়ী জীবন।