হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, হুঁ, দেড় হাজার টাকার একটা বিলও ধরিয়ে দিয়েছেন।
তখনকার দিনে দেড় হাজার টাকা অনেক টাকা।
রাতের বেলা তাঁর অতিপ্রিয় একজনের ভাইয়ের বিয়েতে যেতে হবে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। আমরা সবাই রেডি। কিন্তু হুমায়ূন ভাইয়ের তেমন ইচ্ছা নেই যাওয়ার। তাঁর ইচ্ছা নিজের ফ্ল্যাটে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন।
সেটা সম্ভব না। যেতেই হবে।
আমরা রওনা দিলাম। অনেক রাতে। বিয়েশাদির খাওয়াদাওয়া শেষ। আমরা যাওয়ার পর নতুন করে অ্যারেঞ্জ করা হলো। খেতে শুরু করেছি। হুমায়ূন ভাই একবার মাত্র সামান্য বিরানি মুখে দিয়েই প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতের ধাক্কায় প্লেট সরিয়ে প্রিয় মানুষটিকে বললেন, তুমি জানো না, আমি ঠান্ডা খাবার খাই না?
খাবার তেমন ঠান্ডা ছিল না, তবু তিনি রাগলেন। এই রাগটা আসলে ওই রাগ, যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না; প্ৰকাশ করলেন অন্যভাবে। আর খেলেনই না। উঠে চলে এলেন। তার সঙ্গে আমাদেরও খাওয়া হলো না।
গেণ্ডারিয়ায় আমাদের বন্ধু আলমগীর রহমানের বাড়িতে বহু বছর আগে আমরা খুব আডা দিতাম। আলমগীর ভাইয়ের স্ত্রী ঝরনা ভাবির রান্নার কোনো তুলনা হয় না। আলমগীর ভাই নিজেও খুব ভালো রান্না করেন। আমরা বিকেলবেলা আড্ডা দিতে বসি! রাতের বেলা তার ওখানে খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরি। ও রকম এক বিকেলবেলা হুমায়ূন ভাই এসে বললেন, আমি একটা সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছিলাম, ন্যাকের লোম কাটার কথা বলে নাপিত আমার নাকে কাঁচি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। চুল না। কাটিয়েই চলে আসছি। আলমগীর, একজন নাপিত ডেকে আনান, আমি আপনার এই বারান্দায় বসে চুল কাটাবো।
০৭. অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না
চুয়াডাঙ্গা থেকে এক ভদ্রমহিলা ফোন করলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আপনার লেখাটা নিয়মিত পড়ছি। তিনি এখন কেমন আছেন এ কথা। আপনি একবারও লিখছেন না। আমরা জানতে চাই তিনি কেমন আছেন।
আমি বিনীতভাবে বললাম, আমি তাঁর অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না। আমার কলম সায় দেয় না। তবে তাঁর অসুস্থতার কথা, তিনি এখন কেমন আছেন এসব দুচার দিন পর পর সব কাগজেই লেখা হচ্ছে।
ভদ্রমহিলা একটু নাছোড় ধরনের। বললেন, আপনি কবে কীভাবে তাঁর অসুস্থতার কথা জানলেন?
আমার বলতে ভালো লাগছিল না। ব্যস্ততার ভান করে ফোন রেখে দিলাম। আজ এই লেখা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, সেই ভদ্রমহিলার মতো হয়তো অনেক পাঠকের জানার আগ্রহ, আমি কীভাবে হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতার কথা জানলাম।
ঘটনাটা বলি।
আমার বহু বছরের পুরনো বন্ধু আলমগীর রহমান। বাংলাদেশের অত্যন্ত রুচিশীল ও বিখ্যাত প্ৰকাশন সংস্থা প্রতীক আর অবসরের স্বত্বাধিকারী। একসময় চমৎকার গল্প লিখতেন, সাংবাদিকতা করতেন। তারপর এলেন প্রকাশনায়। খুবই বন্ধুবৎসল মেজাজি মানুষ আলমগীর ভাই।
হঠাৎ একদিন তাঁর ফোন, মিলন, আপনি হুমায়ুনের সঙ্গে দেখা করেন।
আমি অবাক। হুমায়ূন ভাই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন?
হ্যাঁ। শাশুড়ির পায়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। নিজের চেকআপও করিয়ে আসছে। আপনি দেখা করেন। তিন দিন পর হুমায়ূন আমেরিকায় যাচ্ছে।
আমি ছিলাম গাড়িতে। অফিসে যাচ্ছিলাম। আলমগীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, জরুরি কিছু?
বলতে পারব না। আপনি দেখা করেন।
আমি একটু চিন্তিত হলাম। ব্যাপারটা কী?
ফোন করলাম মাজহারকে। কী খবর, মাজহার? আলমগীর ভাই ফোন করে বললেন…
হ্যাঁ। আপনি স্যারের সঙ্গে দেখা করেন।
ব্যাপারটা কী?
মাজহার বিষন্ন গলায় বললেন, খারাপ খবর আছে।
কী হয়েছে?
হুমায়ূন ভাইয়ের কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
আমি যেন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কথাটা। কী? কী ধরা পড়েছে?
কোলন ক্যান্সার।
প্ৰথমে দিশেহারা হলাম, তারপর স্তব্ধ। কথা বলতে পারছি না।
মাজহার বললেন, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ভাবি বললেন, আসছ যখন, তোমার চেকআপটিাও করিয়ে নাও। চেকআপ করাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওখানে চিকিৎসা করাতে রাজি হন নি। পরশুর পরদিন নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। আমিও যাচ্ছি। সঙ্গে। মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। এই হাসপাতালে সোনিয়া গান্ধীরও ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়েছে। পৃথিবী-বিখ্যাত হাসপাতাল।
মাজহার বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার কানে যেন ঢুকছে না কিছুই। মৃতের মতো অফিসে এলাম। কোনো কাজে মনই বসল না। প্ৰায় সারাটা দিন আমার রুমের সোফায় শুয়ে রইলাম। রাতের বেলা একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম দখিন হাওয়ায়। গিয়ে দেখি, হুমায়ূন ভাই যে জায়গাটায় বসে লেখালেখি করেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, সেখানে তাঁর পাশে বসে আছেন জুয়েল আইচ। কিছুক্ষণ পর আলমগীর ভাই এলেন, মাজহার এলেন। আমাকে দেখে সব সময়কার মতো হুমায়ূন ভাই বললেন, আসো, মিলন। বসে।
আমি তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শুরু করলেন তাঁর রসিকতা, শোনো মিলন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে আমার আর আমার মায়ের বাইপাস হয়েছিল। একইরুমে পাশাপাশি বেড়ে রাখা হয়েছিল মা-ছেলেকে। এরকম ইতিহাস ওই হাসপাতালে নেই। মায়ের পাওয়া গিয়েছিল। ৯টি ব্লক, ছেলের ১১টি। এবার ওই হাসপাতালে চকআপে গেছি। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, অমুক রুমে যাও। গেলাম। আরেক ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, আরে, তোমার তো ক্যান্সার। বললেন এমন ভঙ্গিতে, যেন ক্যান্সার কোনো রোগই না। সর্দি-কাশির মতো সামান্য কিছু।