তোর নাম কী?
মোবারক হোসেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর।
দেশের বাড়ি কোথায়?
কিশোরগঞ্জ।
ভালো জায়গায় জন্ম। বীর সখিনার দেশ।
ছেলেমেয়ে কী?
তিন মেয়ে, এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম-মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহা আর ছেলের নাম ইয়াহিয়া।
কী বলিস তুই? ছেলের নাম ইয়াহিয়া?
আমার দাদিজান রেখেছেন। নবীর নামে নাম।
আয় আমার সঙ্গে।
স্যার, কোথায় যাব?
তোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠব। তারপর তোকে হুকুম দেবী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দেখি হুকুম তামিল করতে পারিস কি না।
মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার, চলেন।
শেখ মুজিব মোবারক হোসেনকে নিয়ে দোতলায় এলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, এই, আমাদের দুজনকে নাশতা দাও। এ হলো আমার এক ছেলে।
অতি সামান্য এক ঘটনায়, মাত্র কয়েক লাইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের প্রধান দিকটি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুললেন হুমায়ূন আহমেদ। মানুষের প্রতি এই মহান নেতার তীব্ৰ ভালোবাসা, অন্যদিকে তার জন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। জীবন দিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চরিত্রটি এল এভাবে :
তাঁর চোখ কালো চশমায় ঢাকা। গায়ে ধবধবে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। বসেছেন ঋজু ভঙ্গিতে। বাঁ হাতের কজিতে পরা ঘড়ির বেল্ট সামান্য বড় হয়ে যাওয়ায় হাত নাড়ানোর সময় ঘড়ি উঠানামা করছে। এতে তিনি সামান্য বিরক্ত, তবে বিরক্তি বোঝার উপায় নেই। যে চোখ মানবিক আবেগ প্ৰকাশ করে, সেই চোখ তিনি বেশির ভাগ সময় কালো চশমায় ঢেকে রাখতে ভালোবাসেন। মানুষটার চারপাশে এক ধরনের রহস্য আছে।
তাঁর নাম জিয়াউর রহমান।
মেজর জিয়া এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এম শফিউল্লাহ এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে এক বৈঠকেও খোলাখুলি নিজের এই মত প্ৰকাশ করেন। তার কথা হলো—গেরিলা ধরনের এই যুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার কমান্ড কাউন্সিল। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন না।
জোছনা ও জননীর গল্পতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কথা লেখা হয়েছে। এইভাবে :
নিয়াজীর ফোপানো একটু থামতেই জেনারেল নাগরা তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী।
জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জামশেদ অবাক হয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। তাদের স্তম্ভিত ভাব কাটতে সময় লাগল। একসময় নিয়াজী করমর্দনের জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন কদের সিদ্দিকীর দিকে।
কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না।
এ রকম বহু স্মরণীয় উদ্ধৃতি তুলে ধরতে ইচ্ছা করছে। কত চরিত্র, কত ঘটনার কথা মনে পড়ছে! শাহেদ, আসমানী, জোহর, মোবারক, গৌরাঙ্গ, নাইমুল, মরিয়ম, শাহ কলিম, রুনি, বি হ্যাপি স্যার, ধীরেন্দ্র রায়চৌধুরী ও কংকন। আর অতি ছোট চরিত্র হারুন মাঝি, যে ছিল একজন ডাকাত।
একটি উত্তাল সময় কীভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে, কীভাবে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজীবিত হয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল মানুষ, এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে সেই কথা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন স্তরের মানুষ, কখনো একজন ঠেলাগাড়িওয়ালা, কখনো হুমায়ূন আহমেদের নিজ পরিবার, মা-বাবা, ভাইবোন, পাঙ্খাপুলার রশিদ, নানা স্তরের নানা মানুষ, কারও সঙ্গে কারও হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই, আবার সবাই যেন সবার সঙ্গে যুক্ত। যে সুতায় সব মানুষকে একত্রে গেঁথে জোছনা ও জননীর গল্প নামের এই মহৎ মালাটি হুমায়ূন আহমেদ গেঁথেছেন, সেই মালার নাম উনিশ শ একাত্তরের বাংলাদেশ। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যাবে-ক্ৰোধে, আবেগে, ঘূণায়, মমতায় এবং চোখের জলে ভাসবে মানুষ।
তারও অনেক পরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ি-গোফ ভর্তি এক যুবক এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, সিঁড়িতে যে মেয়েটি বসে আছে, তাকে কি আমি চিনি? দীর্ঘকায় এই যুবক দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম চিৎকার করে বলল, মা, দেখো কে এসেছে! মাগো, দেখো কে এসেছে!
মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে—আহা, এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছ কেন? আমাকে ছাড় তো। আমার লজ্জা লাগে। নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরে ছিল না। তার হাত এখনো প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।
পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে, সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত বলেই আমি এ রকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছি। বাস্তবের সমাপ্তি এ রকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখে নি। সে ফিরে আসতে পারে নি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্ৰান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনা রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহা রে! আহা রে!