খানিকটা নয়, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আপনি প্রায় সবখানিই ধরেছেন। জোছনা ও জননীর গল্প লিখে আপনি আপনার লেখকজীবন পূর্ণ করেছেন। এ রকম একটি উপন্যাস লেখার পর একজন লেখকের আর কিছু চাওয়ার থাকে না।
হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য লেখার সঙ্গে জোছনা ও জননীর গল্প একেবারেই মেলে না। এ একেবারেই অন্য ধাচের রচনা। অতি সরল এবং আশ্চর্য রকমের নিরাসক্ত, ঘরোয়া ভাষায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে গেছেন তিনি। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই তিনটি কালকে কখন যে একাকার করে দিয়েছেন গল্পের ভেতর, কখন যে পাঠককে নিয়ে গেছেন স্বপ্নে, কখন ফিরিয়ে এনেছেন বাস্তবে—টেরই পাওয়া যায় না। উপন্যাস রচনার কোনো প্রচলিত রীতি তিনি মানেনই নি। যেভাবে লিখে আনন্দ পেয়েছেন, যেভাবে পাঠককে বোঝাতে পেরেছেন—গল্প সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যেখানে যে তথ্যের প্রয়োজন, নির্বিকারভাবে তা ব্যবহার করেছেন, ফুটনোটে উল্লেখ করেছেন তথ্যসূত্র। কোথাও কোথাও মুক্তিযুদ্ধের দলিল প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ যখন যেখানে যা প্রয়োজন, যেমন করে সাজালে উপন্যাসটি পূর্ণাঙ্গ হবে তা-ই করেছেন। বহুটুকরোটাকরা গল্প, ঘটনা, চরিত্র আর ইতিহাসের উপাদানকে মহৎ শিল্পীর ভঙ্গিতে জোড়া দিয়ে দিয়ে যে সময়কে তিনি সম্পূর্ণ তুলে ধরেছেন, সেই সময়ের নাম উনিশ শ একাত্তর। ফলে এই উপন্যাস একাধারে আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় সময়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং মূল্যবান দলিলও। হুমায়ূন আহমেদ শুধু উপন্যাসই লেখেননি, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস লেখার মহৎ দায়িত্বটিও পালন করেছেন।
এই উপন্যাসে চরিত্র হয়ে এসেছেন মওলানা ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, টিক্কা খান, অর্থাৎ সেই সময়কার সব শ্ৰদ্ধেয় ও নিন্দিত মানুষ। ভারতীয় বাহিনীর চরিত্ররা এসেছেন যে যাঁর ভূমিকায়। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছেন, রাজাকাররা এসেছে, শর্ষিনা পীর সাহেব এসেছেন, আর এসেছে যারা দেশের নানা স্তরের নানা রকম মানুষ। ছোট, বড় এবং ঐতিহাসিক এত চরিত্রের সমাহার। আর কোনো বাংলা উপন্যাসে এভাবে এসেছে কি না, এত সার্থকভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
আজকের দুই নেত্রীর সেই সময়কার অবস্থার কথা এসেছে, শেখ জামালের কথা এসেছে, শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের জন্মের কথা এসেছে। এত সহজ ও সাবলীলভাবে এসেছে, পড়ে পাঠকের মনে হবে, আরে এইসব মানুষের কথা এভাবেও লেখা যায়!
ইরতাজউদ্দিন তখন মওলানা সাহেবকে চিনলেন- ইনি মওলানা ভাসানী! পত্রিকায় কত ছবি দেখেছেন। এই প্রথম সামনাসামনি দেখা।
ইরতাজউদ্দিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মওলানা ভাসানী তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ঘুম ভালো হয়েছে? যেন কত দিনের চেনা মানুষ।
ইরতাজউদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি।
আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করেছি, কিছু মনে করবেন না।
ইরতাজউদ্দিন আরও লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। এ রকম একজন বিখ্যাত মানুষের সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা যায় না। তিনি উঠে দাড়ালেন।
এই ইরতাজউদ্দিন হুমায়ূন আহমেদের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। পরাধীন দেশে জুমার নামাজ হয় না, জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এ কারণে ক্যাপ্টেন বাসেত তাঁকে নীলগঞ্জ স্কুল এবং বাজারে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় প্রদক্ষিণ করায়।
বাজারে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল। দরজির দোকানের এক দরজি একটা চাদর দিয়ে ছুটে এসে ইরতাজউদ্দিনকে ঢেকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটল যে সঙ্গের মিলিটারিরা বাধা দেবার সময় পেল না।
ইরতাজউদ্দিন এবং দরজিকে মাগরেবের নামাজের পর সোহাগী নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করা হলো। মৃত্যুর আগে আগে ইরতাজউদ্দিন পরম নির্ভরতার সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে উঁচু গলায় শেষ প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহপাক, যে মানুষটা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাচাতে চেয়েছিল, তুমি তার প্রতি দয়া করো। তুমি তার প্রতি তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।
পরদিন প্রবল বৃষ্টিতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে নীলগঞ্জ হাই স্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেব। আর তাঁর পাগল স্ত্রী আসিয়া সোহাগী নদীর পাড় থেকে ইরতাজউদিনের লাশ টেনে আনার সময় এলাকার কোনো বাঙালি নয়, রেলুচ রেজিমেন্টের সিপাহি আসলাম খাঁ তাদের সঙ্গে হাত মেলায়।
কলমের সামান্য আঁচড়ে আঁকা আসলাম খাঁ চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক বোঝালেন, পাকিস্তান আর্মিতেও দু-একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন।
শেখ সাহেব হেসে ফেলে বললেন, তুই তো তোর গোপন কথা সবই বলে ফেললি। তুই আইবির লোক, তুই তোর পরিচয় গোপন রাখবি না?
আমি সরকারের হুকুমে আসলেও ডিউটি করি আপনার। আমি খেয়াল রাখি, যেন কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
আমার ডিউটি করিস কী জন্যে?
কারণ আপনিই সরকার।
শেখ মুজিব এই কথায় খুবই তৃপ্তি পেলেন। মোবারক হোসেনের কাধে হাত রেখে বললেন, তুই আমার জন্যে কী করতে পারবি?
আপনি যা করতে বলবেন, করতে পারব। যদি বলেন, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়, আমি পড়ব।