পত্রিকার সম্পাদক একটু ফাঁপরে পড়েন। তারপর কিছুদিনের গ্যাপে আবার শুরু হয় লেখা, কয়েক কিস্তির পর আবার বন্ধ। ঈদসংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক, সিনেমা-সবই লিখছেন হুমায়ূন আহমেদ, শুধু জোছনা ও জননীর গল্প লিখছেন না।
কেন?
তাঁর লাখ লাখ পাঠকের মতো তামার মনেও প্রশ্নটি ঘুরঘুর করে। দুইবারে লেখা কয়েক কিস্তি পড়ে অস্থির হয়ে আছি। কবে শেষ হবে এই উপন্যাস? কবে পুরোটা পড়া যাবে? দেখা হলে জিজ্ঞেস করি। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মজা করেন। জোছনা ও জননীর পল্প প্ৰসঙ্গ এড়িয়ে যান। সময় কাটে সময়ের মতো। হৃদয়ে দুৰ্যোগ নামে লেখকের। সিঙ্গাপুরে গিয়ে বাইপাস করান। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগমুহূর্তে, অ্যানেসথেশিয়ার কল্যাণে অবচেতন হওয়ার মুহূর্তে তাঁর মনে পড়ে, একটি কাজ বাকি রয়ে গেল , জোছনা ও জননীর গল্প লেখা। মাতৃভূমির ঋণ শোধ করা হলো না।
ফিরে এসে লেখা শুরু করেন।
এবার আর কিস্তি কিস্তি নয়, কোনো পত্রিকায় ধারাবাহিক নয়, সরাসরি লেখা শেষ করা, বই বের করা। পরম করুণাময়কে ধন্যবাদ যে এবার আর তিনি থেমে যান নি, লেখা শেষ করেছেন।
২০০৪ সালের কথা। জোছনা ও জননীর গল্প এখন পাঠকের হাতে হাতে। বাংলা একাডেমী বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি। ৪০০ টাকা দামের বইটির চার-পাঁচটি সংস্করণ হয়ে গেছে সপ্তাহখানেকের মধ্যে। প্রকাশক অন্যপ্রকাশ।
বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলে জোছনা ও জননীর গল্প-র জন্য দীর্ঘ লাইন ধরতে দেখেছি পাঠককে। কোনো কোনো দিন বাঁধাইয়ের কারণে বই থাকত না স্টলে। ইস্, সে সময় যে কী হাহাকার পাঠকের! এসব দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। একজন লেখক যে কী ধরনের জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করতে পারেন পাঠকের মনে, হুমায়ূন আহমেদ তার একমাত্র উদাহরণ : বাংলা ভাষার কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটে নি।
হুমায়ূন আহমেদের পাঠকরা জানেন, লেখায় এক ধরনের ঘোর তৈরি করেন তিনি, এক ধরনের মায়া বিস্তার করেন। একবার তাঁর লেখার ভেতর ঢোকার অর্থ হচ্ছে, সেই মায়ার জগতে বন্দি হওয়া। পড়া শেষ হওয়ার পরও ঘোর সহজে কাটতে চায় না। পাঠক আচ্ছন্ন থাকে অনেক দিন।
জোছনা ও জননীর গল্প পড়ে এখনো আচ্ছন্ন হয়ে আছি আমি।
তবে লেখায় শুধু যে পাঠককেই আচ্ছন্ন করেন হুমায়ূন আহমেদ তা নয়, তিনি নিজেও আচ্ছন্ন হন। লেখার সময় তাঁর নিজের মধ্যেও তৈরি হয় আশ্চর্য রকমের এক ঘোর। জোছনা ও জননীর গল্প লেখার সময় তাঁকে এ রকম ঘোরে পড়তে দেখেছি আমি। দিনভর মাথা নিচু করে লিখছেন, চা খাচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন, প্রািফ দেখছেন, লেখা বদলাচ্ছেন, কাটাকাটি করছেন আর পড়ছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলা-ইংরেজিতে লেখা হেন বই নেই, হেন পত্রপত্রিকা নেই, যা না পড়েছেন। সন্ধ্যার পর সাধারণত লেখেন না। তিনি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দেন। সেই আড্ডার সময়ও লক্ষ করেছি, সবার সঙ্গে থেকেও কোন ফাঁকে তিনি যেন একা হয়ে গেছেন। তাঁর মন চলে গেছে। উনিশ শ একাত্তরে। মনে মনে জোছনা ও জননীর গল্পের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো সাজাচ্ছেন তিনি। নিজের মধ্যে প্রবল ঘোর তৈরি না হলে তিন-চার মাসের মধ্যে ৪৯৩ পৃষ্ঠার এ রকম একটি মহৎ উপন্যাস লিখে শেষ করা যায় না। সঙ্গে আছে ছয় পৃষ্ঠার চমৎকার একটি ভূমিকা। আর ব্যাপক পড়াশোনার কথা তো আগেই বললাম।
এতক্ষণে পাঠক সংগত কারণেই আশা করবেন, উপন্যাসটির ভালো-মন্দ নিয়ে আমি কিছু কথা বলব, কিছু সমালোচনা করব, উপন্যাসটির দোষ-ত্রুটি ধরব, অমুক জায়গায় তমুক হলে ভালো হতো, ওই চরিত্রটি যেন হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে, অমুক অমুক তথ্যে গণ্ডগোল আছে ইত্যাদি। সবিনয়ে বলি, ওটি আমার কাজ নয়। ওই কাজটি করবেন গবেষক-সমালোচকরা। আমি গবেষক কিংবা সমালোচক নই। যদিও জোছনা ও জননীর গল্প-র পূর্বকথায় ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
জোছনা ও জননীর গল্প কোনো ইতিহাসের বই নয়, এটি একটি উপন্যাস। তার পরও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। সেখানেও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। হওয়াটা স্বাভাবিক। উপন্যাস যেহেতু কোনো আসমানি কিতাব নয়, এসব ভুলভ্রান্তি দূর করার উপায় আছে।
উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষ এনেছি। এই স্বাধীনতা একজন ঔপন্যাসিকের আছে। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলায় কোনো ভুল যদি করে থাকি, তার জন্য আগেভাগেই ক্ষমা চাচ্ছি। অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি—একজন লেখক যা লিখবেন সেটাই সত্যি।
সেই সত্য যা রূচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি রামের জনম স্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্য। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা, কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেওয়া। প্রকাশিত হওয়ার আগেই এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি (এই প্রজন্মের পাঠকের কথা বলছি), তারা পড়ার পর বলেছে, উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এ রকমও কি হয়?
তাদের কাছে আমার একটাই কথা, সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ-সবই বাস্তব আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ংকর সুন্দর সুররিয়েলিষ্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।