তবে অন্য একটি বিষয়ে কিছু করা উচিত বলে আমাদের মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ন মাসে অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগলাভ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে কেউ কেউ নিযুক্ত হন ডা. মালেক-মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য থেকে শুরু করে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মুসলিম লীগ-দলীয় চেয়ারম্যানের (স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তিনি নিহত হন) লিখিত সুপারিশে। অনেক ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট পদটি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকেরা যথারীতি আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নির্বাচনী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ায় যারা দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন তারা আর সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকার সুযোগ পাননি, ফলে প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কনিষ্ঠেরা প্রার্থিত পদ লাভ করে তাদের ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন। উপাচার্য ইন্নাছ আলী মুক্তিযুদ্ধকালীন সব নিয়োগ পরীক্ষা করে দেখে এ-বিষয়ে সুপারিশ করার জন্যে মোহাম্মদ শামসুল হক, রশিদুল হক আর আমাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। আমরা সব কাগজপত্র দেখে মতামত দিই যে, রাজনৈতিক সুপারিশের জোরে যেসব নিয়োগদান করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হোক; মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচক কমিটির সভায় যেসব আবেদনকারী উপস্থিত হতে পারেননি, তাঁদেরকে আবার ডাকা হোক এবং ওইসব পদে নিয়োগের ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক; একটি বিভাগে পাকিস্তান প্রত্যাগত একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিয়োগদান করা হয়েছিল, সেই নিয়োগ বহাল রাখা হোক।
ওইসব সুপারিশ যখন সিন্ডিকেটে বিবেচিত হতে যাচ্ছে, তখন মহা আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুজ্জামান হীরা ছিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নেরও সভাপতি। তার নেতৃত্বে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সিন্ডিকেটের সভা ঘেরাও করে বসলো। তাদের একটিই দাবি : মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করা চলবে না। আমাদের সুপারিশের বিবেচনা বন্ধ রেখে উপাচার্য পরে ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, শেষ পর্যন্ত আরেকটি সিন্ডিকেট-সভায় তার মতামত দিলেন : আমাদের সুপারিশ যুক্তিসংগত হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেলায় তা প্রয়োগ করা সম্ভবপর নয়। আমরা মনে করলাম, এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়াও সংগত নয়। যদি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সুপারিশ কার্যকর না হয়, তাহলে শিক্ষক-কর্মকর্তা কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা সংগত হবে না। সুতরাং আমরা নিজেদের সুপারিশ নথিবদ্ধ হয়ে থাকতে দিলাম।
আরেকটি বিষয়ে আমি বিচলিত হয়েছিলাম। আমি এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্টের দায়িত্ব আবার গ্রহণ করেছি। ছাত্রেরাই তখনো হলের মেসের ব্যবস্থাপনায় থাকে। একদিন কিছুসংখ্যক ছাত্র আমার বাড়িতে এসে দেখা করে বললো, তারা হলের মেসে গরুর গোশত খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চায়। হলটি যেহেতু সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যে উন্মুক্ত এবং পাকিস্তান-আমলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আবাসিক হলে গোমাংস-সরবরাহের ব্যবস্থার কথা কখনো ওঠেনি, সুতরাং এ-দাবিতে বিস্মিত হলাম এবং তাদেরকে সেকথা বললাম। বিষয়টি ভেবেচিন্তে পরে আবার আলোচনা করবো বলে তাদের বিদায় দিলাম। দিন দুই পরে হলের অফিসে বসেই আলোচনা হলো। দেখলাম, যারা দাবি করছে, তারা বেশ সংগঠিত এবং ব্যাপারটি কেবল বিশেষ খাদ্যপ্রীতি থেকে উদ্ভূত হয়নি। হাউজ-টিউটর এবং আরো কিছু ছাত্রের সঙ্গে আলোচনা হলো।
মেসের ব্যবস্থাপনা যেহেতু ছাত্রদের হাতে, তাই তাদের মতের প্রতিকূলে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া চলে না। ঘটনাক্রমে দেখা গেল, কিছু মুসলমান ছাত্র গোমাংস খাওয়ার পক্ষপাতী নয়। তখন দুটি মেস চালু করার সিদ্ধান্ত হলো : একটিতে গোমাংস চলবে, অন্যটিতে তা থাকবে না।
৬.
ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু গেলেন কলকাতায়। সেখানে। তিনি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পেলেন। কলকাতার জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ কথাটা যোগ করলেন তিনি। এই সফরের সময়েই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্থির হয় যে, ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবে। ১৯৭১ সালে যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, ইতোমধ্যে তাঁদের অনেকেই আবার এই সেনাদের প্রত্যাবর্তনের জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। আবার অনেকে মনে করলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুরোপুরি গঠিত না হয়ে থাকলেও, ভারতীয় সৈন্যদের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তাকে স্বচ্ছ করে তুলবে।
ফিরতি সফরে ইন্দিরা গান্ধি ঢাকায় এলেন ২৭ মার্চে। ঢাকায় তার নাগরিক সংবর্ধনাও জমকালো হয়েছিল। রেসকোর্সে বড়ো মঞ্চ তৈরি হলো, বিশাল জনসভা হলো। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে অল্পসংখ্যক সংস্কৃতিকর্মীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বঙ্গভবনে। ইন্দিরা গান্ধি বেশ সলজ্জভাবে কথা বলছিলেন ও চলাফেরা করছিলেন। আমার অনুরোধে আমন্ত্রিতদের পক্ষ থেকে কবীর চৌধুরী ভাষণ দিলেন–সংক্ষিপ্ত, মনোজ্ঞ ও উদীপ্ত। ইন্দিরাও জবাবে সুন্দর বললেন। তার এই সফরের সময়েই ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি হয়। এই চুক্তি নিয়ে যত সমালোচনা হয়েছিল, চুক্তি তার সামান্য ভাগও কার্যকর হয়নি।