মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কর্তাদের নির্দেশে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীকে ঢাকা সেনানিবাসে কয়েকটি নৃত্যগীতানুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। এখন সেই দায়িত্ব এসে পড়ল তার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমদ হোসেনের ওপরে। মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতশিল্পী মোরাদ আলী অভিযোগ আনে আহমদের বিরুদ্ধে এবং তাদের দুজনকে নিয়ে আমি দিনতিনেক বৈঠক করি। শেষ পর্যন্ত স্থির হয়, বাফার সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আহমদ ইস্তফা দেবে। ব্যাপারটা আহমদের জন্যে গভীর দুঃখের কারণ হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতজন শিক্ষক-কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন, অনেকে কারাভোগ করেছেন, পাকিস্তান-সমর্থকেরা বেশ দাপটও দেখিয়েছেন–ফলে উত্তেজনটা সেখানে ছিল কিছু বেশি। অনেকেই আশা করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করলে এসব বিষয়ে প্রত্যাশিত সুরাহা হবে।
জানুয়ারি মাসের শেষদিকে সৈয়দ আলী আহসান আমাকে বললেন, শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী চান আমাকে বাংলা একাডেমির পরিচালক নিযুক্ত করতে। আমি সম্মত কি না, তা জেনে নেওয়ার ভার দিয়েছেন তিনি আলী আহসান সাহেবকে। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, শিক্ষকতার বাইরে কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই, বোধহয় যোগ্যতাও নেই; সুতরাং শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁর প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানানো ছাড়া আমার করণীয় নেই, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই ফিরে যাবো।
ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু আগে-পরে সব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে গেল। তার আগে নতুন উপাচার্য নিযুক্ত হলেন–ঢাকায় মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, রাজশাহীতে খান সারওয়ার মুরশিদ, জাহাঙ্গীরনগরে সৈয়দ আলী আহসান, চট্টগ্রামে এম ইন্নাছ আলী। সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগরে চলে আসায় কর্মে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষরূপে আমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী শহীদ হয়েছেন–ওই পদে কে নিয়োগলাভ করবেন, তা নিয়ে কিছুটা জটিলতা দেখা দিলো। কর্মে জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে বিভাগে মুনীর চৌধুরীর পরে ছিলেন কাজী দীন মুহম্মদ–পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার দায়ে তিনি কারারুদ্ধ। তাঁর পরে ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী–তিনিও শহীদ হয়েছেন। তাঁর পরে ছিলেন আহমদ শরীফ–অতএব অধ্যক্ষের পদটি স্বাভাবিকভাবে তারই। প্রাপ্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বিভাগের কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাও আবার পাকিস্তানের দালাল এক রাজনীতিবিদের সঙ্গে এসে–এই নিয়ে একটা প্রচারণা-অভিযান চললো তার বিরুদ্ধে। জ্যেষ্ঠতায় আহমদ শরীফের পরে ছিল নীলিমা ইব্রাহিমের স্থান। তিনি যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁর এক জামাতা ছিল ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ-দলীয় সদস্য অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য। এই সূত্রে ক্ষমতাসীন দলের অনেকের সঙ্গে তার সম্ভাব গড়ে উঠেছিল। বিভাগের জনকয়েক শিক্ষকও তাঁর পক্ষে কাজ করতে নামলেন। ফলে, নীলিমা ইব্রাহিম অধ্যক্ষ হলেন। আহমদ শরীফ ব্যাপারটিকে দেখলেন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি সরকারের বিরূপতা বলে। অচিরেই তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন সরকারের কঠোর সমালোচকরূপে। বাংলা বিভাগে তাঁর ও নীলিমা ইব্রাহিমের অনুসারীরা কার্যত দুটি দলে ভাগ হয়ে রইলেন বহুদিন পর্যন্ত।
৫.
চট্টগ্রামে এসে নতুন করে সংসার পাততে হলো। হাঁড়িকুড়ি বাসনকোশন সব কিনতে হবে। নিউ মার্কেটে টি-সেট কিনতে গেছি, অনুপম সেন কোত্থেকে আবির্ভূত হয়ে বাধা দিলেন। বললেন, তার প্রতিবেশী তার দুটি টি-সেট রক্ষা করেছেন, তার একটা উনি আমাকেই দান করবেন। খুব যে আপত্তি করেছিলাম, তা মনে হয় না। অনুপমের দেওয়া সেই চায়ের পাত্র বহুদিন আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মানবসম্পদের হানি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি–তাই এখানে উত্তেজনা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অবনীমোহন দত্তকে চট্টগ্রাম শহরে সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক, সেই হিসেবে আমাদের একমাত্র শহীদ শিক্ষক। আমাদের কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে জেলেও যেতে হয়নি। তবু দেখা গেল, অনেক সহকর্মী এসে বলছেন, এই ক মাসে শিক্ষকদের মধ্যে কারা বেতারে কথিকা পড়েছিলেন, কারা পাকিস্তান কাউনসিলে সেমিনার-সিম্পোজিয়মে বক্তৃতা করেছিলেন, কারা কাগজে বিবৃতি দিয়েছিলেন–আর এসব কথিকা-বক্তৃতা-বিবৃতিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আমি তাঁদের বলেছি, দেখুন, দেশে থেকে গেলে হয়তো আমিও অমন কিছু করতে বাধ্য হতাম। সরাসরি পাকিস্তান সরকার বা সেনাবাহিনীকে সাহায্য না করে থাকলে কিংবা তাদের কোনো কাজের ফলে অন্য কেউ নির্যাতিত না হয়ে থাকলে এসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন না করাই ভালো। অভিযোগকারীরা ক্ষুণ্ণ মনে চলে গেছেন। একই মর্মে স্বনামে-বেনামে লিখিত অভিযোগপত্র পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তার প্রতিলিপি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের তিনজনের কাছেও পাঠানো হয়েছিল : পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক, গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ রশিদুল হক আর আমার কাছে–মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা তিনজনই ছিলাম ভারতে শরণার্থী।