২৭ জানুয়ারি আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে। নতুন পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছিল এর লক্ষ্য। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল আর অংশ নিয়েছিলেন ঢাকার অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সভায় একটি কমিটি গঠিত হয় সুফিয়া কামালকে আহ্বায়ক এবং কামরুল হাসান, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জহির রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমাম, ডা. সারোয়ার আলী ও আমাকে সদস্য করে। এই উদযোগে একটা বড়ো ভূমিকা ছিল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের।
২৯ তারিখে এই কমিটির আহ্বানে আরেকটি সভা আয়োজিত হয় বিএমএ ভবনে। উদ্দেশ্য, বিশদ আলোচনা এবং আরো বড়ো করে মতবিনিময়। সকালবেলায় বোরহান আমাকে ফোন করে জানালো, বিকেলের সভায় জহির আসতে চাইছে না, তুমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলো। ফোন করতেই জহিরকে পেয়ে গেলাম। আমি তাকে সভায় আসতে বলি, সে আসতে পারবে না বলে মিনতি করে। শেষে জানায়, নিরুদ্দিষ্ট অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার-সম্পর্কিত একটা খবর পেয়েছে সে, তার সূত্র ধরে সে অনুসন্ধানে যাচ্ছে, ফিরে এসে সবটা বলবে আমাকে।
নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের সভা হয়ে গেল, জহিরের কোনো খবর নেই। পরদিন খোঁজ নিয়ে শুনি, সঙ্গীদের ফিরিয়ে দিয়ে জহির একাই ঢুকে গেছে মিরপুরের কোনো বাড়ির মধ্যে। সেখানে গোলাগুলি হয়েছে–আমাদের পুলিশ ও সেনা সদস্য জখম হয়েছে, কিন্তু জহির ফিরে আসেনি। কী সর্বনাশ! এমন খবর তো কাগজেও পড়িনি! না, ইচ্ছে করেই খবর দিতে দেওয়া হয়নি; এখনো চেষ্টা চলছে শহীদুল্লা কায়সারকে না পাওয়া গেলেও জহির রায়হানকে উদ্ধার করার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জহির সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠন করতে। সরকার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সে নিজেই গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিল নিজেকে আহ্বায়ক করে। গুছিয়ে কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা তার তখন ছিল না। দাদার অন্তর্ধানে সে একেবারে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধেও তার যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল–কিছুটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ঘটনায়, কিছুটা বুদ্ধিজীবী-হত্যার তদন্তে সরকারের উদযোগহীনতায়। তাই সে একা একাই যতটা সম্ভব করতে চেয়েছিল এবং তা করতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেল।
৪.
স্বাধীনতালাভের আনন্দের মধ্যেও নানা ক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে এক ধরনের জটিলতা ও উত্তেজনা দেখা দিলো। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, তারা দেশে ফিরে যখন প্রশাসনের হাল ধরলেন, তখন অনেক সময়ে দেশে কর্মরত তাঁদের জ্যেষ্ঠ বা সমসাময়িক কর্মকর্তাদের তারা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেটা কারা কীভাবে মেনে নিয়েছিলেন, তা বলা শক্ত, তবে মুজিবনগর-প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের অনেকে সহকর্মীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। প্রশাসনে পাকিস্তান সরকারের সোৎসাহী সমর্থক কেউ কেউ ছিলেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্যদের থেকে তাঁদের স্বতন্ত্র করে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না। কাগজে দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে খেতাব নেওয়ার দায়ে বেশ কয়েকজন কর্ম থেকে অপসারিত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন, ড. এরফান আলী, অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েকদিনে, চট্টগ্রামে সর্বতোভাবে আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এই তালিকায় আরো কেউ কেউ ছিলেন যাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার অভিযোগ ছিল না। আবার সত্যি যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে বহাল তবিয়তে কাজেই থেকে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, এমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চিহ্নিত করার জন্যে পরে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটিতে ছিলেন সাবেক পিএসপি এ বি এম সফদার। সফদার পাকিস্তানের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা বলে সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন। বেতার-টেলিভিশনের শিল্পীদের মধ্যে পাকিস্তানের সহযোগী খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন তার প্রধান। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে কিছু শিল্পীকে বেতার-টেলিভিশনে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে অনেকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছিল, অনেক প্রকৃত সহযোগী টাকাপয়সা দিয়ে বা প্রভাব খাঁটিয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।
এভাবে, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মানুষ যেন নানাভাগে বিভক্ত হতে শুরু করেছিল। মুজিবনগর-প্রত্যাগতদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল অন্যদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুনেছি, আমাদের দুজন সহকর্মীর ব্যবহারে তাঁদের ব্যক্তিগত বন্ধুরাও আহত বোধ করেছিলেন। সরকারবিরোধীরা এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকা প্রথম পাতায় একটি রিপোর্টের ব্যানার হেডিং দিয়েছিল : সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটরস্। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি লোক বাদে আর-সবাই পাকিস্তানিদের সহযোগী। বলা বাহুল্য, এমন মনোভাব কারো ছিল না, কিন্তু অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ওই শিরোনাম অনেকের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল।